জন্মভূমি ডেস্ক : বাংলাদেশে বিপুলসংখ্যক বিদেশী নাগরিক কর্মরত রয়েছেন। তাদের অনেকেরই কাজের অনুমতি নেই। কিন্তু এ বিদেশীদের হাত ধরে বিপুল পরিমাণ অর্থ দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। আবার কর ফাঁকির কারণে রাজস্ব থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে সরকার। পাশাপাশি সংকুচিত হচ্ছে স্থানীয়দের কাজের সুযোগ। এ পরিস্থিতি উন্নয়নে কাজ শুরু করেছে সরকার। প্রাথমিকভাবে ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে অবস্থানরত বিদেশীদের একটি পরিসংখ্যান তৈরি করা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, দেশে অবস্থানরত বিদেশীদের সংখ্যা ১ লাখ ৭ হাজার ১৬৭। তাদের বেশির ভাগই ভারত ও চীনের নাগরিক।
কাজের অনুমতি ছাড়াই বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশী কর্মী বা নাগরিকদের বিষয়ে করণীয় নির্ধারণে গতকাল রাজধানীতে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) আয়োজনে আগারগাঁওয়ের বিনিয়োগ ভবনে আয়োজিত এ সভায় সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া। সভায় অনুমতি ছাড়া দেশে অবস্থানরত বিদেশী কর্মী বা নাগরিকদের বিষয়ে করণীয় নির্ধারণের লক্ষ্যে বিভিন্ন সুপারিশ ও মতামত তুলে ধরা হয়।
বিডার নির্বাহী সদস্য মোহসিনা ইয়াসমিন এ ধরনের ব্যক্তিদের বাংলাদেশে অবস্থানের কারণ, এতে সৃষ্ট সমস্যা, ডিজিটালাইজেশন সংক্রান্ত সুপারিশ, এ-থ্রি ভিসা, জরিমানা বা শাস্তি, কাজের অনুমতি নিশ্চিতকরণ, অনুমতি প্রদানকারী দপ্তরগুলোর মধ্যে সমন্বয়, ভিসা অন অ্যারাইভাল ও কালো তালিকাভুক্তি সংক্রান্ত নানা সুপারিশ তুলে ধরেন।
সভায় পেশ করা আনুষ্ঠানিক উপস্থাপনার শুরুতেই কাজের অনুমতি ছাড়া বিদেশীদের বাংলাদেশে অবস্থানের কারণ তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, কোনো সমন্বিত তথ্যভাণ্ডার না থাকায় বিজনেস ভিসা (বি-ভিসা) ও ট্যুরিস্ট ভিসায় (টি-ভিসা) বিদেশীরা কাজের অনুমতি না থাকলেও কোনো প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই দেশে অবস্থান করতে পারার সুযোগ নিচ্ছে।
আইন অনুযায়ী বাংলাদেশে অবস্থান করে কাজ করলে আয়কর প্রদান ও কাজের অনুমতি নেয়া বাধ্যতামূলক। এ-থ্রি ভিসায় বহু বিদেশী বিভিন্ন প্রকল্পে কাজ করলেও ২০০৬ সালে প্রণীত ভিসা নীতিমালায় কাজের অনুমতি গ্রহণের শর্ত না থাকায় এ-থ্রি ভিসাধারীরা কাজের অনুমতি নেন না। এতে তাদের জন্য আয়কর ফাঁকি দেয়া সহজ হয়।
উপস্থাপনায় উঠে আসে কাজের অনুমতিবিহীন বা মেয়াদোত্তীর্ণ ভিসায় অবস্থানকারীরা যতদিনই অবস্থান করেন না কেন মাত্র ৩০ হাজার টাকা জরিমানা দিয়ে বাংলাদেশ ত্যাগ করতে পারেন। প্রদেয় করের চেয়ে জরিমানা কম হওয়ায় কেউ অনুমতি নেয়ার প্রতি ভ্রুক্ষেপ করছেন না।
সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দপ্তর বা সংস্থার মধ্যে তথ্য আদান-প্রদানের সুযোগ না থাকায় কাজের অনুমতিবিহীন বিদেশীরা দীর্ঘদিন বাংলাদেশে অবস্থানের সুযোগ পাচ্ছেন। পুরনো পাসপোর্টের স্থলে নিজ নিজ দেশের ঢাকাস্থ দূতাবাস থেকে নতুন পাসপোর্ট নিয়ে দেশ ছাড়তে পারছেন এবং পুনরায় আসার সুযোগ পাচ্ছেন। কালো তালিকাভুক্ত বিদেশীরাও নতুন পাসপোর্ট ব্যবহার করে নতুনভাবে ভিসা নিয়ে প্রবেশ করছেন। অনুমতি ছাড়া অবস্থানের অন্যতম কারণ হিসেবে বাংলাদেশে অবস্থান করে বিদেশীদের ভিসার শ্রেণী পরিবর্তনের সুযোগ থাকার বিষয়টিও সভায় উঠে আসে।
বিদেশীদের অবৈধ অবস্থানের কারণে স্থানীয় কর্মীদের চাকরির সুযোগ সংকুচিত হয়। কর্মানুমতি ছাড়া কাজ করে নগদে বেতন-ভাতা গ্রহণ করে অবৈধভাবে হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে অর্থ পাঠানো হয়। মেয়াদোত্তীর্ণ ভিসায় অবস্থানরত বিদেশীরা নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত হন। এসব সংকট নিরসনে তাৎক্ষণিকভাবে তথ্যপ্রাপ্তি নিশ্চিতে একটি কেন্দ্রীয় অনলাইন ইন্টার-অপারেবল তথ্যভাণ্ডার তৈরির সুপারিশ করেছে বিডা। সংস্থাটি বলছে, এই তথ্যভাণ্ডার সুরক্ষা সেবা বিভাগ, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বিডা, বেপজা, বেজা, হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষ, এনজিও অ্যাফেয়ার্স ব্যুরো, এনএসআই, ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর এবং স্পেশাল ব্রাঞ্চের প্রবেশযোগ্যতা থাকতে হবে। এছাড়া সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার সঙ্গে ইন্টার-অপারেবল করে বাংলাদেশী মিশনগুলোর ভিসা প্রদানের প্রক্রিয়া যেন অনলাইন ও অটোমেটেড করা হয়।
এ-থ্রি ভিসার ক্ষেত্রে আবশ্যিকভাবে কর্মানুমতি গ্রহণের শর্ত আরোপের সুপারিশ করেছে বিডা। সংস্থাটি বলছে, সুরক্ষা সেবা বিভাগ কর্তৃক জারীকৃত এ-থ্রি ভিসার ধরন পরিবর্তন বা এ-থ্রি ভিসার মেয়াদ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে আবশ্যিকভাবে ১৫ দিনের মধ্যে কর্মানুমতি গ্রহণের শর্ত আরোপ করতে হবে। কাজের অনুমতি গ্রহণের বিষয়টি নিশ্চিতকল্পে বিদেশীদের পাসপোর্টে এ-থ্রি ভিসার পৃষ্ঠাঙ্কনেরও তাগিদ দিয়েছে সংস্থাটি।
বিডার সুপারিশে বলা হয়, বাংলাদেশী মিশনগুলোর মাধ্যমে এ-থ্রি শ্রেণীর ভিসার সব শর্ত ও যোগ্যতা ভালোভাবে বিশ্লেষণ করে শুধু যথোপযুক্তদের অনুকূলে যেন এ ভিসা দেয়া হয়। যথাযথ শ্রেণীর ভিসা ছাড়া বা মেয়াদোত্তীর্ণ ভিসাধারী ও অনুমতিহীন বিদেশী নাগরিকদের হোটেল বা বাড়িতে অবস্থানের সুযোগ দানকারীদের যেন জরিমানা করা হয়। যেসব প্রতিষ্ঠান কর্মানুমতিতে কর্মীদের প্রকৃত বেতন-ভাতার তথ্যাদি সঠিকভাবে উল্লেখ করে না, তাদেরও জরিমানার বিধান করতে হবে।
সভা শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া বলেন, ‘আয়কর ফাঁকি দিয়ে অনেক বিদেশী নাগরিক এ-থ্রি ভিসা, বি-ভিসা কিংবা ট্যুরিস্ট ভিসায় কাজ করছেন। অনেক ক্ষেত্রে তারা এক প্রতিষ্ঠানের জন্য কাজে এসে অন্য প্রতিষ্ঠানে চলে যাচ্ছেন। ২০০৬ সালে প্রণীত ভিসা নীতিমালায় কর্মানুমতি গ্রহণের শর্ত না থাকায় অনেকে আবার কর্মানুমতি না নিয়ে কিংবা ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও বছরের পর বছর কাজ করে মাত্র ৩০ হাজার টাকা জরিমানা দিয়ে দেশ ছাড়েন। এক্ষেত্রে আমরা দৈনিক ও প্রগ্রেসিভ হারে জরিমানা আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন সময়ে অনেকে বলে থাকেন, বাংলাদেশে চার-পাঁচ লাখ বিদেশী আছেন। যেহেতু অবৈধ বিদেশী নাগরিকদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা বা সংখ্যা আমাদের হাতে নেই, তাই বলা চলে এটা নিছক অনুমাননির্ভর।’
মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া জানান, পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ ও সুরক্ষা সেবা বিভাগের রিপোর্ট অনুসারে ৩১ ডিসেম্বর ২০২৩ পর্যন্ত বাংলাদেশে অবস্থানরত বৈধ বিদেশী নাগরিকদের সংখ্যা ১ লাখ ৭ হাজার ১৬৭। এর মধ্যে ব্যবসা ও বিনিয়োগসংক্রান্ত ভিসায় এসেছেন ১০ হাজার ৪৮৫ জন, এমপ্লয়ি ভিসায় ১৪ হাজার ৩৯৯, স্টাডি ভিসায় ৬ হাজার ৮২৭ ও ট্যুরিস্ট ভিসায় এসেছেন ৭৫ হাজার ৪৫৬ জন। সবচেয়ে বেশি রয়েছেন ভারতীয় নাগরিক ৩৭ হাজার ৪৬৪ জন। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা চীনের নাগরিক রয়েছেন ১১ হাজার ৪০৪ জন।
বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান লোকমান হোসেন মিয়া বলেন, ‘বিদেশীরা কর্মানুমতি ছাড়া কাজ করায় তাদের অর্জিত অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে বাইরে চলে যাচ্ছে। এতে ক্রমান্বয়ে আমাদের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দেশের উন্নয়নের জন্য বিদেশী নাগরিকদের নিয়ম মেনেই বাংলাদেশে কাজ করতে হবে।’
সভায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ, বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান শেখ ইউসুফ হারুন, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোকাম্মেল হোসেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মাসুদ বিন মোমেন, সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব মো. আবদুল্লাহ আল মাসুদ চৌধুরী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। বেপজার নির্বাহী চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল আবুল কালাম মোহম্মদ জিয়াউর রহমান, হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের এমডি জিএসএম জাফরুল্লাহ, এনজিওএবি মহাপরিচালক শেখ মো. মনিরুজ্জামান এতে অংশ নেন। আরো উপস্থিত ছিলেন বিডার নির্বাহী সদস্য অতিরিক্ত সচিব অভিজিৎ চৌধুরী, বিডার নির্বাহী সদস্য মো. খাইরুল ইসলাম, স্পেশাল ব্রাঞ্চের অতিরিক্ত মহাপুলিশ পরিদর্শক মনিরুজ্জামান, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালক নাফিউল হাসান, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক মোহম্মদ ফাইজুর রহমান, ডিপিআই ডিজি মেজর জেনারেল মো. নুরুল আনোয়ার প্রমুখ।