করোতোয়া পাড়ে স্বজনদের আহাজারি, অর্ধশত লাশ উদ্ধার
# নৌকায় ১শ’ জনেরও বেশি লোক ছিলাম
# দুর্ঘটনাকবলিত নৌকা দিয়েই চলছে উদ্ধার কাজ
# ৭৩ বছরে একসঙ্গে এত মরদেহ দেখিনি
# পরিবারের চার সদস্য হারিয়ে নির্বাক রবিন চন্দ্র
# ছেলেকে বুকে নিয়ে বেঁচে ফিরলেন মা, মেয়ে নিখোঁজ
# দেড় মাস আগে বিয়ে, করতোয়ায় বিচ্ছেদ
# পানিতে না নেমে শুধু নৌকায় ঘুরছে ফায়ার সার্ভিস, অভিযোগ স্বজনদের
জন্মভ‚মি ডেস্ক
পঞ্চগড়ে করতোয়া নদীতে হিন্দু পুণ্যার্থীদের বহনকারী নৌকা ডুবে যাওয়ার ঘটনায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০ জনে। সোমবার (২৬ সেপ্টেম্বর) রাত ৮টায় উদ্ধার অভিযান স্থগিত করে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কর্তৃপক্ষ এ তথ্য জানিয়েছে। পঞ্চগড় ও দিনাজপুর জেলার করতোয়া ও আত্রাই নদীর বিভিন্ন স্থান থেকে এসব মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এখনও প্রায় ৪০ জন যাত্রী নিখোঁজ রয়েছেন।
পঞ্চগড়ের ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপ-সহকারী পরিচালক শেখ মো. মাহবুবুল ইসলাম বলেন, রাত ৮টার দিকে উদ্ধার অভিযান স্থগিত করা হয়। তবে আমাদের দুটি ইউনিট নদীর তীরেই রাতযাপন করবে। ভোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তারা উদ্ধার অভিযান শুরু করবেন। আর গত দু’দিনের উদ্ধার অভিযানে মোট ৫০টি মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।
ঘটনার পর মাড়েয়া ইউনিয়ন পরিষদে স্থাপিত জরুরি তথ্য ও সহায়তা কেন্দ্রের দায়িত্বরত কর্মকর্তা বোদা উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভ‚মি) মো. ইমরানুজ্জামান বলেন, রাতে উদ্ধার অভিযান স্থগিত করা হয়। এখন পর্যন্ত ২৫ নারী, ১৩ শিশু ও ১২ পুরুষসহ ৫০ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দলের তিনটি ইউনিট উদ্ধার কাজ পরিচালনা করছে। তবে বেশিরভাগ মরদেহ স্থানীয় ব্যক্তিরা উদ্ধার করছেন বলে জানান তিনি।
এরআগে, দুপুর ২টা পর্যন্ত ২১ নারী, ১১ শিশু ও সাত পুরুষসহ ৩৯ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। তাদের মধ্যে সাত জনের মরদেহ ভেসে গিয়েছিল দিনাজপুরের আত্রাই নদীতে। সেখান থেকে মরদেহগুলো উদ্ধার করা হয়েছে। পরে বিকালে আউলিয়ার ঘাট এলাকা থেকে আরও দুই লাশ উদ্ধার হয়।
এদিকে নিখোঁজদের মরদেহের অপেক্ষায় করতোয়ার পাড়ে অবস্থান নিয়েছেন স্বজনরা। অনেককে নৌকা নিয়ে নদীতে প্রিয়জনকে খুঁজে বেড়াতেও দেখা গেছে। কারও হাতে ছিল নিখোঁজ স্বজনের ছবি। কোনও মরদেহ উদ্ধারের খবর জানতে পারলেই নিখোঁজ স্বজনকে শনাক্ত করতে স্থানীয় মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়ন পরিষদে ছুটে যাচ্ছেন তারা। এছাড়া দিনভর ঘটনাস্থলে ছিল হাজার হাজার উৎসুক মানুষের উপস্থিতি।
দুর্ঘটনা তদন্তে পঞ্চগড় জেলা প্রশাসনের গঠিত কমিটির প্রধান ও অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট দীপঙ্কর রায় জানান, উদ্ধার মরদেহগুলো পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হচ্ছে। অনেকে স্বজনদের মরদেহ খুঁজে পাওয়ার পর আমাদের অবহিত করেছেন। মরদেহ সৎকারের জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাথাপিছু ২০ হাজার টাকা করে দেওয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।
প্রসঙ্গত, রবিবার (২৫ সেপ্টেম্বর) দুপুরে বোদা উপজেলার মাড়েয়া ইউনিয়নের আউলিয়ার ঘাট এলাকায় নৌকাডুবির ঘটনা ঘটে। মহালয়া উপলক্ষে মাড়েয়া বাজার এলাকার আউলিয়া ঘাট থেকে শ্যালো ইঞ্জিনচালিত নৌকাযোগে ৮০ জনের বেশি যাত্রী বড়শশী ইউনিয়নের বদেশ্বরী মন্দিরে (নদীর অপর পাড়ে) যাচ্ছিলেন। একপর্যায়ে মাঝ নদীতে নৌকাটি ডুবে যায়। এ সময় কয়েকজন সাঁতরে তীরে ওঠেন। ঘটনাস্থলেই ১৭ জনের মৃত্যু হয়।
এ ঘটনাটি তদন্ত করতে রাতে পঞ্চগড়ের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট দ্বীপংকর রায়কে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে জেলা প্রশাসন। কমিটিকে আগামী তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
\ দুর্ঘটনাকবলিত নৌকা দিয়েই চলছে উদ্ধার কাজ \
পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলায় করতোয়া নদীতে নৌকাডুবির ঘটনায় এখনো পর্যন্ত ৪৯ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। এ ঘটনায় নিখোঁজ বাকিদের খুঁজতে দুর্ঘটনাকবলিত সেই নৌকা দিয়েই উদ্ধার কাজ শুরু করেছে ফায়ার সার্ভিস রংপুরের ডুবুরি দল।
রোববার (২৫ সেপ্টেম্বর) দুপুর আড়াইটার দিকে উপজেলার মাড়েয়া ইউনিয়নের আউলিয়া ঘাট এলাকায় নৌকাডুবির ঘটনা ঘটে। পরে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা পর রংপুর থেকে ডুবুরি দল এসে সন্ধ্যা ৬টার দিকে উদ্ধার কাজ শুরু করে।
ফায়ার সার্ভিস জানায়, তাৎক্ষণিকভাবে কোনো নৌকা না পাওয়ায় সেই নৌকা দিয়েই উদ্ধার কাজ শুরু করা হয়েছে।
\ ৭৩ বছরে একসঙ্গে এত মরদেহ দেখিনি \
‘চারপাশে শুধু কান্নার আওয়াজ। পুরো গ্রামজুড়ে কান্নার রোল পড়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি, বয়স ৭৩ বছর পার হয়েছে। জলে ডুবে একসঙ্গে এত মানুষের মৃত্যু কখনো দেখিনি। আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনা এটি। ছোট বাচ্চা, নারী-পুরুষ অনেকে মারা গেছে।’ পঞ্জগড়ে করতোয়া নদীতে নৌকাডুবির ঘটনায় নিহতদের লাশ দেখতে এসে এসব কথা বলেন স্থানীয় বৃদ্ধ উন্মানাত বর্মণ।
নৌকাডুবিতে নিহত অনেকের লাশ রাখা হয়েছে বামনহাট ইউনিয়ন পরিষদে। সত্তোরোর্ধ উম্মানাত বর্মণের বাড়ি ওই ইউনিয়নে। সোমবার (২৬ সেপ্টেম্বর) দুপুরে নৌকাডুবিতে মৃতদের মরদেহ দেখতে আসেন তিনি। এখানে এসে একসঙ্গে অনেক লাশ দেখে আবেগ-আপ্লæত হয়ে পড়েন এ বৃদ্ধ।
\ পরিবারের চার সদস্য হারিয়ে নির্বাক রবিন চন্দ্র \
পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলার শালডাঙ্গা ইউনিয়নের হাতিডুবা ছত্রশিকারপুর গ্রামের বাসিন্দা রবিন চন্দ্র। পেশায় ভাটাশ্রমিক। নৌকা ডুবে তার পরিবারের চারজন মারা গেছেন, একজন বেঁচে ফিরেছেন। নৌকাডুবিতে রবিনের স্ত্রীর সঙ্গে মারা যায় তার তিন বছর বয়সী ছেলে বিষ্ণু রায়। এছাড়া ছোট ভাই কার্তিক রায়ের স্ত্রী ল²ী রানী (২৫) ও বড় ভাই বাবুল রায়ের ছেলে দীপঙ্করও (৩) মারা গেছেন।
নির্বাক রবিন চন্দ্র বলেন, সারাদিন কাজ করে টাকা জমাচ্ছিলাম নতুন কাপড় চোপড় কেনার জন্য। সেই টাকা দিয়ে এখন লাশ সৎকার করতে হবে। বাচ্চাটা খুব বায়না ধরেছিল নতুন কাপড় নেবে। আমি বলেছিলাম, মহালয়া শেষ হলে তারপর কিনে দেবো। আমার বাচ্চার আর নতুন কাপড় পরা হলো না। আমার সব শেষ হয়ে গেল। কি নিয়ে বেঁচে থাকব আমি?
\ ছেলেকে বুকে নিয়ে বেঁচে ফিরলেন মা, মেয়ে নিখোঁজ \
‘নৌকায় ওঠার সময় দুলতে ছিল। মাঝিরা কইছিল কিছুই হবে না। যাওয়া যাবে। অনেক চাপাচাপি করে নৌকাখান ছাড়ল। স্বামী, দুই সন্তান ও শাশুড়িসহ উঠছিলাম। দুলতে দুলতে মাঝখানে গিয়ে উল্টে গেল। আমার বুকে ৮মাসের বাচ্চাটা ছিল। বাম হাত দিয়ে বাচ্চাটা ধরে রাখছি আর ডান হাত দিয়ে নৌকা। আমার পুরো শরীর ডোবা। পানির নিচে অনেকক্ষণ ডুবেছিলাম। তারপর আর কিছু বলতে পারছি না। পরে ঘাটে এসে জ্ঞান আসে। আমি আর বাচ্চাটা পড়ে আছি। কিন্তু আমার মেয়েটাকে এখনো খুঁজে পাইনি। আমার মেয়ের সন্ধান চাই। লাশটা হলেও আমাকে উদ্ধার করে দিন।’
\ দেড় মাস আগে বিয়ে, করতোয়ায় বিচ্ছেদ \
দেড় মাস আগে সাত পাকে বাঁধা পড়েছিলেন হিমালয়-বন্যা। আসন্ন দুর্গাপূজা ঘিরে দেখেছিলেন নানা স্বপ্ন। রোববার দুপুরে পরিবারের সবার সঙ্গে মন্দিরে মহালয়া উপলক্ষে ধর্মসভায় যোগ দিতে যাচ্ছিলেন। সেখানে গিয়ে করতোয়ার পানিতে স্নান করে পাপমুক্তির আশা ছিল। তবে কে জানত সেই করতোয়ায় বিচ্ছেদ ঘটাবে তাদের।
মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়নের করতোয়ার পূর্ব পাড়ে বোদেশ্বরী মন্দির দর্শনের উদ্দেশে যাওয়ার সময় নৌকা ডুবে নিখোঁজ রয়েছেন স্বামী হিমালয়। তবে উপস্থিত বুদ্ধি দিয়ে নিজের কাপড় খুলে প্রাণে বাঁচেন বন্যা। কিন্তু আকড়ে রাখতে পারেননি স্বামীকে। তাদের সঙ্গে থাকা হিমালয়ের মামাতো বোন আঁখিরও খোঁজ মেলেনি।
\ নৌকায় ১শ’ জনেরও বেশি লোক ছিলাম \
করতোয়া নদীতে নৌকাডুবির ঘটনায় ৫০ জনের মৃত্যু হয়েছে। নিখোঁজ রয়েছেন অনেকে। অতিরিক্ত যাত্রীর চাপেই নৌকাটি ডুবে যায় বলে জানিয়েছেন বেঁচে ফেরা যাত্রীরা।
সাঁতরে নদীর তীরে ফিরে আসা দিপু বলেন, নদীর মাঝখানে যাওয়ার পর হঠাৎ করে নৌকা দুলতে থাকে। তারপর আমি নিচে পড়ে যাই। কিছুক্ষণ আমি কিছুই বুঝতে পারিনি। তারপর সাঁতার কাটলাম। আমি আমার নিজ হাতে তিনটা মরদেহ উদ্ধার করেছি। আরও কয়েকজনকে বাঁচিয়েছি। বেশি লোক নৌকায় নেওয়ায় নৌকাটা ডুবে যায়। ১০০ জনেরও বেশি লোক আমরা নৌকায় ছিলাম।
আরেক যাত্রী তুরেণ বলেন, নতুন করে জীবন ফিরে পেয়েছি। নৌকাওয়ালা অতিরিক্ত লোক নেওয়ার কারণে এতগুলো মানুষের প্রাণ গেল। আমার কয়েকজন আত্মীয়-স্বজনকে এখনো খুঁজে পাইনি।
\ পানিতে না নেমে শুধু নৌকায় ঘুরছে ফায়ার সার্ভিস, অভিযোগ স্বজনদের \
নৌকাডুবির ঘটনায় নিখোঁজদের মরদেহ উদ্ধারে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা তৎপর নয় বলে অভিযোগ উঠেছে। উদ্ধার কাজ করছে সাধারণ মানুষ। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের বার বার বলার পরও কেউ পানিতে নামছেন না। পানিতে লাশ থাকার কথা বললেও তারা স্থানীয়দের পানিতে নামতে বলছেন বলে অভিযোগ করেছেন নিখোঁজদের স্বজনরা।
স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সোমবার সকাল থেকে প্রতিটি মরদেহ উদ্ধার করেছে সাধারণ মানুষ। মরদেহ উদ্ধারের পর ফায়ার সার্ভিস এসে তাদের নাম গণমাধ্যমে প্রচার করছে।
বীরেন্দ্র নাথ নামে এক ব্যক্তি বলেন, ‘এখানে ফায়ার সার্ভিস খালি মহড়া দিতে আসছে। নৌকায় করে এ কিনারা, ও কিনারা ঘুরে বেড়াচ্ছে।’
ষাটোর্ধ্ব শরিফ উদ্দীন বলেন, ‘সকাল থাকি দেখনু কেউ নামে নাই পানিতে। এলাকার মানুষ লাশগুলা তুলি আনেছে। আর হাকাও সরকার বেতন দেয় ফায়ার সার্ভিসের লোককে।’
পরিমল সরকার নামে এক ব্যক্তি বলেন, ‘ফায়ার সার্ভিস শুধু নৌকা দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। একবারও দেখলাম না পানিতে নামতে। এভাবে কী উদ্ধার কাজ হয়, নাকি নাটক হয়।’ এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন পঞ্চগড় ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের সহকারী পরিচালক মাহবুল ইসলাম।
দ্বিতীয় দিনের অভিযান স্থগিত, মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৫০
Leave a comment