ধর্ষণ এর ইংরেজি প্রতিশব্দ “রেপ” শব্দটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ রেপিয়ার থেকে যার অর্থ বলপূর্বক কেড়ে নেওয়া বা খামচে ধরা। চৌদ্দ শতক থেকে শব্দটির ব্যবহার শুরু হয়েছে (উইকিপিডিয়া)। সাধারণ অর্থে ধর্ষণ হলো যৌন আক্রমণ বা অপরাধমূলক যৌন আচরণ। অর্থাৎ একজন ব্যক্তির অনুমতি ব্যতিরিকে শারীরিক বলপূর্বক তার সাথে যৌন সঙ্গম করা। তবে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী বা শিশু যারা সম্মতি দিতে অক্ষম তাদের সাথে জোরপূর্বক মিলিত হওয়াও ধর্ষণ। এমনকি নিজের স্ত্রীর সাথে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে যৌন মিলনকেও ধর্ষণ বলে। যুগে যুগে এবং দেশে দেশে ধর্ষণের সংজ্ঞায় পার্থক্য হলেও আধুনিক কালে ধর্ষণ বলতে বলপূর্বক পুরুষের দ্বারা নারীর বা নারীর দ্বারা পুরুষের শ্লীলতাহানিকে বোঝায়।
সাম্প্রতিককালে ধর্ষণের ঘটনা মারাত্মকভাবে বেড়ে গেছে। মনে হয় যেন ধর্ষণের প্লাবন বয়ে চলেছে। উন্নত, অনুন্নত সব সমাজে বা দেশেই ধর্ষণের ঘটনা ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। তবে দক্ষিণ আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা এবং এশিয়ার ভারত, বাংলাদেশ, আফগানিস্তান প্রভৃতি অনুন্নত, স্বল্প শিক্ষিত, কুসংস্কারাচ্ছন্ন এবং আইনের শাসনের শিথিলতা আছে এমন দেশগুলিতে ধর্ষণের হার বেশি। দক্ষিণ আফ্রিকায় বছরে গড়ে পাঁচ লক্ষ ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। গত বছরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে তেরটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে (দি নিউ এইজ, ১৮ মে ২০১৯)। এই হিসেবে বছরে চার হাজার ৭৪৫টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। পত্রিকাটি এখানে পুলিশের বরাত দিয়ে পরিসংখ্যানটি উল্লেখ করেছে। তবে বেসরকারি সংস্থা বা বিভিন্ন মানবাধিকার সংঘটনের মতে এই হার নিঃসন্দেহে আরো বেশি হবে।
ধর্ষণের উল্লেখযোগ্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে-অতৃপ্ত যৌন আকাঙ্খা, নগ্নতা ও বেহায়াপনা, অবাধ মেলামেশা, নগ্ন পোষ্টার, অশ্লীল পত্র-পত্রিকা ও সিনেমা, নীল ছবি, প্রেমে ব্যর্থতা, প্রতিহিংসা, একাকিত্ব ও হতাশা, অপমান ও রাগ, মাদকাসক্ততা, মানসিক চাপ, নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষার অভাব, পারিবারিক উশৃঙ্খলতা, বিকৃত রুচি ইত্যাদি।
ধর্ষণের ফলে ধর্ষিতা শারীরিক ও মানসিকভাবে মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখিন হয়। ধর্ষণের ভয়াবহ ফলাফল গুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- প্রজনন সমস্যা, স্ত্রী বিষয়ক বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়া, যৌন সমস্যা, বন্ধ্যাত্ব, শ্রোর্ণী প্রদাহ, গর্ভধারণ জটিলতা, গর্ভপাত, যৌন অক্ষমতা, এইচআইভি ও এইড্স এ আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে পড়া, রক্তপাত থেকে মৃত্যু, আত্মহত্যা, মানসিক ও শারীরীক বৈকল্য, যৌনাঙ্গে স্থায়ী ক্ষত ও প্রদাহ, অনাকাঙ্খিত গর্ভধারণ ও গর্ভপাত, সামাজিক মর্যাদাহানী ইত্যাদি।
আমাদের দেশের মত পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নারীরাই ধর্ষণের জন্য বেশি অরক্ষণীয় (ভালনারেবল)। ধর্ষণের বিরুদ্ধে আইন থাকলেও তার কঠোর প্রয়োগ ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির নজির খুব কম। ধর্ষক যদি সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে প্রভাবশালী হয় বা প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় লালিত পালিত হয় বা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত থাকে তবে তাকে আড়াল করা বা ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার প্রবণতা আমাদের দেশে ধর্ষণকে আরো উৎসাহিত করে। অনেকে আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে যায় এবং নিলর্জের মত আবার বুক ফুলিয়ে চলে। গ্রামীণ সমাজে ধর্ষককে নামমাত্র অর্থ দÐ বা বেত্রাঘাতের মত মামুলি শাস্তি দিয়ে তার জঘন্য কর্মকাÐকে বরং উৎসাহিতই করা হয়। উল্টোভাবে ধর্ষিতার উপর নেমে আসে নানা প্রকার অপমানজনক সামাজিক ও ধর্মীয় ফতোয়া। এ ক্ষেত্রে ফতোয়াবাজরা ধর্ষিতার দোষ খুঁজে বের করে সমাজে তাকে হেয় করতেই বেশি আগ্রহ দেখায়।
ইদানিংকালে ধর্ষণের সাথে যোগ হয়েছে নানা প্রকার নৃশংসতা। ধর্ষণের পর তার উপর নৃশংস অত্যাচার এমনকি হত্যা পর্যন্ত করা হয়। ২০১২ সালে ভারতে নির্ভয়া নামের এক তরুণীকে চলন্ত বাসে ধর্ষণ এবং তারপর বাস থেকে ফেলে দিয়ে হত্যা বিশ্ব বিবেককে নাড়া দিয়েছিল। অতি সম্প্রতি ভারতের উত্তর প্রদেশে দুই জন দলিত শ্রেণির নারীকে ধর্ষণ শেষে পাশবিক নির্যাতন করে তাদের মৃত্যু মুখে ঠেলে দেওয়া হয়। ঐ দুইজনের একজনের বাড়ি উত্তর প্রদেশের হাতরাসে। তার জিবাহ্ পর্যন্ত কেটে নেওয়া হয়। এমন নির্মম ঘটনা যারা ঘটাতে পারে তারা এক কথায় মানুষরূপী জানোয়ার। এই জঘন্য নির্মমতায় সারা ভারতে তোলপাড় চলছে।
সম্প্রতি আমাদের দেশে সিলেটের এমসি কলেজে এবং খাগড়াছড়িতে দুটি ধর্ষণের ঘটনা ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। সিলেটে এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে নববিবাহিতা এক গৃহবধূকে ঐ কলেজের বর্তমান ও প্রাক্তন ছাত্র নামধারী একদল নরপশু গণধর্ষণ করে। পশ্চাৎপদ মানসিকতার নারীবিদ্বেষীরা নারীর পোশাক পরিচ্ছদ এবং চালচলনকে ধর্ষণের অন্যতম অনুসঙ্গ হিসেবে দায়ী করে থাকে। কিন্তু এই গৃহবধূ তার স্বামীর সাথে প্রাইভেট কারে বেড়াতে বেরিয়েছিলেন। অল্প সময়ের জন্য স্বামী আশেপাশে গেলে নরপশুরা নববধূকে টেনে হিছড়ে ছাত্রাবাসের মধ্যে নিয়ে যায়। পরে স্বামী ফিরে এলে তাকেও মারধর করা হয়। খাগড়াছড়িতে ডাকাতবেশী পশুরা রাতের আঁধারে ঘুমন্ত যুবতীর উপর ঝাপিয়ে পড়ে। অনেক সময় অবুঝ শিশু ও বয়স্ক নারীও ধর্ষণের শীকার হয়। সুতরাং নারীর পোশাক ও চালচলন নয়, বিবৃত মানসিকতা মানুষকে যখন পশুতে পরিণত করে তখনই সে এমন জঘন্য ঘটনা ঘটায়।
সমাজে বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও অন্যান্য কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ধর্ষকরা পার পেয়ে যায়। এর মধ্যে যেটা পার পায় না, দ্রæত ধরা পড়ে ও বিচারের মুখোমুখি হয়, সেখানকার কৃতিত্ব সাংবাদিকদের। তারা ঘটনা যে ভাবে তুলে ধরেন তাতে ঐ ঘৃণ্য অপরাধের বিরুদ্ধে ব্যাপক জনমত সৃষ্টি হয় এবং প্রশাসন বাধ্য হয় দ্রæত ব্যবস্থা নিতে। সিলেটে এমনটিই ঘটেছে। এখন দ্রæত ন্যায় বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয় কিনা সেটাই দেখার বিষয়।
ধর্ষণ প্রতিকারের জন্য পারিবারিক শিক্ষা, নৈতিক শিক্ষা, সামাজিক আন্দোলন ইত্যাদি প্রয়োজন আছে। তবে সর্বাগ্রে প্রয়োজন প্রশাসনের কঠোর মনোভাব। আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারলে অপরাধীরা ভয় পেত এবং অপরাধ করা থেকে কিছুটা হলেও বিরত হত। তারপর যুগপৎভাবে পারিবারিক শিক্ষা, নৈতিক শিক্ষা, সামাজিক আন্দোলন, প্রশাসনিক ব্যবস্থা ইত্যাদির মাধ্যমে ধর্ষকদের বিরুদ্ধে সর্বস্তরের জনগণকে এককাট্টা করে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারলে ধর্ষণ কমতে পারে। সাথে সাথে পণ্য পত্রিকা, অশ্লীল মুভি, অশ্লীল পোষ্টার ইত্যাদি চিরতরে বন্ধ করা। ইন্টারনেট, ইউটিউব ও বিভিন্ন সামাজিক সাইটে যে সব অশ্লীল ছবি বা ভিডিও আপলোড আছে তা কঠোরভাবে তদারকি এবং নিয়ন্ত্রণ করা। ধর্ষণ একটি জঘন্য অপরাধ। তাই ধর্ষককে প্রচÐ ঘৃণা ও সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে।
আমাদের দেশে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদÐের বিধান করতে এ সংক্রান্ত আইন সংশোধন করে অনুমোদন করা হয়েছে গতকাল। মন্ত্রীসভা ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০২০’ এর সংশোধনী অনুমোদন দিয়েছে। প্রসঙ্গত বাংলাদেশের নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে এক নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের পর থেকে গত কয়েকদিন ধরে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদÐ করার দাবি উঠে প্রতিবাদ সমাবেশগুলো থেকে।
এর আগে গত বুধবার আইনমন্ত্রী জানিয়েছিলেন যে মৃত্যুদÐের ব্যবস্থা করার দাবি সরকার বিবেচনা করছে। আজ মঙ্গলবার রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে এটি গেজেট আকারে বের হওয়ার পর সংশোধনী আইনটি কার্যকর হওয়ার ঘোষণা রয়েছে। এর ফলে আগামীতে এই অপকর্ম কমবে বলে সুধিজনেরা মনে করছেন।
(লেখক: প্রভাষক, সরকারি ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মহিলা কলেজ, ফকিরহাট, বাগেরহাট)