হুমায়ুন কবীর রিন্টু , নড়াইল : নড়াইলে ভূমিহীনদের মাঝে বরাদ্দ দেয়া সরকারি জমি ক্রয় করে বিপাকে পড়েছেন বাবুল মোল্যা (৪০) ও ছাবিনা ইয়াসমিন নামে এক অসহায় ভূমিহীন দম্পতি। ক্ষতিগ্রস্থ বাবুল মোল্যা নড়াইল সদর উপজেলার জুড়ালিয়া গ্রামের দিনমজুর রহমান মোল্যার ছেলে। তারা জুড়ালিয়া গ্রামের ছানছার মোল্যা (৫৪) ও তার স্ত্রী রুমিছা বেগম (৪৪) এর নিকট হতে একই এলাকার মালিডাঙ্গা মৌজার ওই জমি ক্রয় করেন।
শনিবার (২৫ জানুয়ারি) সকালে সরজমিন গিয়ে দেখা যায় ক্ষতিগ্রস্থ বাবুল-ছাবিনা ভূমিহীন দম্পতি ক্রয়কৃত জমিতে ঘরবাড়ি তৈরি করে বসবাস করছেন। এ সময় আলাপকালে তারা জানান, প্রতারক ছানছার ও রুমিছা জমি দেয়া বাবদ তাদের নিকট হতে টাকা নেন। এরপর নানা অজুহাতে ওই জমি লিখে না দিয়ে ঘুরাতে থাকেন। এরই মধ্যে প্রতারক রুমিছা বেগম জুড়ালিয়া গ্রামের জাহাঙ্গীর আলমের নিকট হতে টাকা নিয়ে ওই জমি হতে ৬ শতক জমি তাকে লিখে দেন। নিরূপায় হয়ে বিভিন্ন মহলে দৌড়ঝাপ শুরু করেন বাবুল-ছাবিনা দম্পতি। এক পর্যায়ে জানতে পারেন সরকারের নিকট হতে বরাদ্দ নেয়া ওই জমি লিখে দেয়ার কোন ক্ষমতা তাদের নেই। এদিকে প্রতারক দম্পতি জমি দেয়া বাবদ নেয়া টাকা ফেরত দিচ্ছেন না। অপরদিকে ওই জমি লিখে নেয়া জাহাঙ্গীর আলমের ভাই এনামুল ও হুমাউন ওই জমি জবর দখলের পায়তারা করছেন। এমতাবস্থায় বাবুল মোল্যা ও তার স্ত্রী চরম উদ্বিগ্নতার মধ্য দিয়ে দিনাতিপাত করছেন। তারা ওই বসতবাড়িতে শান্তিপূর্ণ ভাবে স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ পেতে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। প্রতারনার শিকার হয়ে বাবুলের স্ত্রী ছাবিনা ইয়াসমিন নড়াইল সদর বিজ্ঞ আমলী আদালতে ছানছার মোল্যা (৫৪) ও তার স্ত্রী রুমিছা বেগম কে আসামী করে দ:বি: ৪০৬/৪২০ ধারায় মামলা দায়ের করেছেন।
ক্ষতিগ্রস্থ বাবুল মোল্যা ও তার স্ত্রী ছাবিনা বেগম এবং মামলা সূত্রে জানা গেছে, জুড়ালিয়া গ্রামের প্রতারক ছানছার মোল্যা (৫৪) ও তার স্ত্রী রুমিছা বেগম ভূমিহীন পরিচয়ে ১৯৮৯ সালের ১৪ এপ্রিল ১৩ নং মালিডাঙ্গা মৌজার আরএস ২৬৪৮ নং খতিয়ানের ৮২২৭ নং দাগের ১২ শতক খাস জমি যৌথভাবে বন্দোবস্ত নেন। ১৯৮৯ সালের ১৩ নভেম্বর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে নড়াইলের ডেপুটি কমিশনার ৯৯ বছরের জন্য ছানছার মোল্যা (৫৪) ও তার স্ত্রী রুমিছা বেগম এর নামে যৌথভাবে ওই জমি বন্দোবস্ত রেজি: দলিল সম্পন্ন করে দেন। যার নং-৫৭৮০/৮৯। উক্ত জমি ৮০ হাজার টাকা বিক্রয় চুক্তিতে আসামীরা ২০২২ সালের ১৮ মার্চ ক্ষতিগ্রস্থ বাবুল মোল্যা ও তার স্ত্রী ছাবিনা বেগম’র নিকট হতে ৬০ হাজার টাকা গ্রহন করেন। জমি লিখে দেয়ার সময় বাকী ২০ হাজার টাকা পরিশোধের চুক্তি হয়। চুক্তি মোতাবেক ২০ হাজার টাকা জোগড়া করে জমি লিখে দেয়ার জন্য আসামীদের অনুরোধ করলে তারা নানা ভাবে ঘুরাতে থাকে। এক পর্যায়ে ২০২৩ সালের প্রথম দিকে গোপনে একই গ্রামের জাহাঙ্গীর আলমের নিকট ওই জমি হতে ৬ শতক জমি বিক্রি ও রেজিষ্ট্রি দলিল করে দেন। যার নং-৪৩৪/২৩।
ক্ষতিগ্রস্থ বাবুল মোল্যা ও তার স্ত্রী ছাবিনা বেগম আরোও জানান, বসবাস অনুপযোগি ওই ১২ শতক জমি ক্রয়ের পর বসবাস উপযোগি করতে এবং ঘরবাড়ি তৈরি করতে তারা দেনা হয়ে প্রায় ৫ লাখ টাকা ব্যয় করেছেন। ঋণ করে এতো টাকা ব্যয় করে ওই জমিতে বসবাস করছেন। কিন্তু তাদের কোন বৈধ মালিকানা নেই। অপরদিকে সরকারি আইনে হস্তান্তর ও বিক্রয় নিষিদ্ধ এ জমি ক্রয় করে জুড়ালিয়া গ্রামের জাহাঙ্গীর আলম দফায় দফায় জবর দখলের হুমকি দিচ্ছেন। ক্ষতিগ্রস্থ বাবুল মোল্যা ক্ষোভের সাথে বলেন জুড়ালিয়া গ্রামের হুমাউন কবির ওই জমি ক্রয়ের কথা জানেন। তিনি নিজে উপস্থিত থেকে এলাকার লোকজনের উপস্থিতিতে ওই জমি মেপে বুঝে দিয়েছেন। এরপর সেখানে ঘরবাড়ি করে বসবাস করছেন। অথচ সেই হুমাউন নিজের ভাই জাহাঙ্গীরের পক্ষ নিয়ে আরেক ভাই এনামুলকে সাথে নিয়ে জমি জবর দখলের চেষ্টা করছেন।
ক্ষতিগ্রস্থ বাবুল আরোও জানান,দিশেহারা হয়ে তিনি তুলারামপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিসে যান। সেখানে সহকারি ভমি কর্মকর্তা আনন্দ কুমার এর নিকট সহযোগিতা চাইলে তিনি খারাপ ব্যবহার করে বলেন, ছানছার ও রুমিছা তাদের জমি বিক্রি করেছে তাতে তোমার কি ? যার কাছে বিক্রি করেছে সে ওই জমি পাবে। এরপর নড়াইল সদর এসি ল্যান্ড এর কাছে গেলে তিনি সার্ভেয়ার মোয়াজ্জেম হোসেন এর নিকট যেতে বলেন। সার্ভেয়ার মোয়াজ্জেম হোসেন সুকৌশলে তার নিকট আর্থিক সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করেন। বাধ্য হয়ে তিনি জেলা প্রশাসক বরাবর লিখিত অভিযোগ দায়ের ও আদালতে মামলা দায়ের করেছেন।
জুড়ালিয়া গ্রামের কাছেদ মোলা (৫৫), ওবিদ মোল্যা (৫০),অবসরপ্রপাপ্ত সেনা সদস্য ইসরাফিল মোল্যা (৪৫),মিকাইল (৩৫) সহ আরোও অনেকে বলেন, বাবুল একজন ভূমিহীন হতদ্ররিদ্র মানুষ। তার কোথাও এক চিলতে জমি নেই। ছানছার ও তার স্ত্রী রুমিছা প্রকাশ্যে অনেক লোকজনের মধ্যস্থাতায় বাবুলের কাছ থেকে টাকা নিয়ে জমি লিখে না দিয়ে চরম প্রতারনা করেছে। তারা জানতো এ জমি হস্তান্তরযোগ্য না। তারপরও তারা এ জমি দেখিযে একাধিক ব্যক্তির নিকট হতে টাকা নিয়ে প্রতারনা করেছে। আর তাদের এ কুকর্মে মহযোগিতা করেছেন নড়াইল সদর সাব-রেজিষ্ট্রী অফিসের দলিল লেখক মোশারেফ। বাবুল খুবই অসহায় হতদরিদ্র। সে অনেক কষ্টে দেনা হয়ে ওই জমি কিনে বসতবাড়ি করে বসবাস করছে। ওই জমি হতে তাকে উচ্ছেদ করা হলে তার কষ্টের সীমা থাকবে না। তারা দাবি জানান,ওই জমি যেন সরকার হতে বাবুল-ছাবিনা দম্পতিকে বরাদ্দ দেয়া হয়।
অভিযুক্ত জুড়ালিয়া গ্রামের জাহাঙ্গীর আলম প্রবাসে থাকায় তার সাথে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে তার ভাই এনামুল ও হুমায়ুন বলেন তারা ৬ শতক জমি রুমিছার নিকট হতে কিনে রেজিষ্ট্রী করে নিয়েছেন। অপরদিকে বাবুল ও তার স্ত্রী ছাবিনা ১২ শতক জমি কিনেছে এটা সত্য। তবে তাদের দখলে রয়েছে ৬ শতক। তাছাড়া তারা জমির রেজিষ্ট্রী করে নিতে পারেনি।
তুলারামপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিসের সহকারি তহশীলদার আনন্দ কুমার বলেন, এ জমি কোন প্রকার হস্তান্তর বা বিক্রয়যোগ্য না। এ বিষয়ে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। সহকারি কমিশনার (ভূমি) দেবাশীষ অধিকারি বলেন, খোঁজ খবর নিয়ে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিবেন। নড়াইল সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সঞ্চিতা বিশ্বাস বলেন, এ জমি হস্তান্তর করা বা দলিল করে দেয়ার কোন সুযোগ নেই। বিষয়টি তিনি গুরুত্ব দিয়ে দেখবেন বলে জানান। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) জোবায়ের হোসেন চৌধুরীর নিকট জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, অনুসন্ধান করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। জেলা প্রশাসক শারমিন আক্তার জাহান বলেন, ক্ষতিগ্রস্থরা গণশুনানীতে লিখিত অভিযোগ দিলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।