সময়টি তখন জমি দখল করে নোনা পানির চিংড়ি চাষের। খুলনা-বাগেরহাটের সুন্দরবন ঘেঁষা উপজেলাগুলোয় ক্ষমতাধরদের কারণে ধানের জমিগুলো একে একে নোনা পানিতে বাগদা চিংড়ির ঘেরে রূপান্তরিত হচ্ছে। অল্প জমির মালিক, ক্ষেতমজুর, দিনমজুর প্রভৃতিরা এর বিরোধিতা করছে। প্রত্যুত্তরে বিভৎস নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। হেনস্তা, নারী নিপীড়ন, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, হত্যাকাণ্ড কি ঘটেনি!
সেই সময়ে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (বা-পাউবো)-এর সাথে নেদারল্যান্ডের এক চুক্তির বদৌলতে ডেল্টা ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (ডিডিপি) নামে একটি প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছিল ২২নং পোল্ডার এলাকায়। ডিডিপি কৃষির উপর নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে জনগণকে এক ফসলের জায়গায় বছরে দুটো ফসল ফলানোর জন্য উদ্বুদ্ধ করছিল। চিংড়ি চাষের ক্ষমতাধর উদ্যোক্তাদের ওই এলাকাটিও নজরে পড়ে।
বাঁধ কেটে যথেচ্ছ নোনা পানি তুলে চিংড়ি চাষ ডিডিপি’র পরীক্ষা-নিরীক্ষার একেবারে বিপরীতমুখী অবস্থানের। একারণে এলাকাবাসী চিংড়ি চাষের বিপক্ষে অবস্থান নেয়। দানা বাঁধতে থাকে চিংড়ি চাষ বিরোধী মনোভাব। জাতীয় পার্টি নেতা ওয়াজেদ আলী বিশ্বাস ওই জায়গাতেই চিংড়ি চাষের উদ্যোগ নেয়। ১৯৯০ সালের মে/জুনের দিকে তাঁর প্রতিনিধিরা গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে হুমকি দেয়। তাদের একটাই কথা, চিংড়ি চাষের বিরোধিতা করা চলবে না, চুক্তি করে জমি দিতে হবে। তারা দলিল নিয়ে প্রান্তিক কৃষিজীবীদের স্বাক্ষর করার জন্যে চাপ দিতে থাকে। বলে সই না করলে মিথ্যা মামলা দিয়ে জেলের ঘানি টানানো হবে। হুমকির মুখে ভীত-আতঙ্কের মধ্যে দিয়ে বেশ কিছু মাঝারী কৃষকের কাছ থেকে সই আদায়ও করা হয়। ধনী এবং শহরবাসী কৃষকরা ওয়াজেদ আলীকে আগেভাগেই তাদের জমি দীর্ঘমেয়াদে লীজ (ইজারা বা ভাড়া) দিয়ে দেয়। বিষয়টি হরিণখোলা বিত্তহীন সমিতির নেতৃবৃন্দকে ভাবিয়ে তোলে। সমিতি নিজেদের কমিটির বৈঠকে বসে আলাপ-আলোচনা করে। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তারা বিষয়টি নিয়ে পোল্ডার কমিটি এবং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের সাথে মতবিনিময় করে। তার চিংড়ি চাষের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়ে ব্যাপক গণ-আন্দোলন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়।
সমিতির সদস্যদের মতে, ২২নং পোল্ডারে চিংড়ি চাষ করা হলে এর প্রতিক্রিয়ায় মাঝারী কৃষক, ভূমিহীন এবং নারীরা চরম সর্বনাশের মুখোমুখি হবে। সমিতির সদস্যরাই চিংড়ি চাষ বিরোধী আন্দোলন সংগঠিত করতে ব্যাপক গণসংযোগ করে। প্রসঙ্গত, ডিডিপি’র আওতায় এনজিও ‘নিজেরা করি’ এখানে ভূমিহীনদের সংগঠিত করার কাজ করে। সমিতিগুলো তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে উঠেছিল। হরিণখোলা ভূমিহীন সমিতিও তেমনি একটি সমিতি। ভূমিহীন সমিতির সদস্যরা ওয়াজেদ আলী বিশ্বাসকে জানায়, তাঁরা ডিসিআর (সরকারের কাছ থেকে বরাদ্দ নেয়া) নিয়ে এই খাস জমি ভোগ-দখল করে। এই জমি তিনি কেড়ে নিতে পারেন না।
দুই পক্ষই নিজ নিজ অবস্থানে অটল থাকে। ওয়াজেদ আলী বিশ্বাস ভূমিহীনদের অধিকার ভূলুণ্ঠিত করে চিংড়ি চাষ করবেই; আর ভূমিহীনরা তা হতে দেবে না। আলাপ-আলোচনা, সভা-সমাবেশ, মত-বিনিময়ের একটি পর্যায়ে আসে উদ্যোক্তার চূড়ান্ত আক্রমণ। সেদিন ৭ নভেম্বর ১৯৯০। সকাল সাড়ে ৮টা। প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছিল। ওয়াজেদের লাঠিয়ালরাও এলাকায় চড়াও হয়। তারা বাঁধের দু’পাশে লোক চলাচল বন্ধ করে দেয়। দ্রুতলয়ে চারটে ঘর তৈরি করে। লাঠিয়ালরা দু’দলে ভাগ হয়ে যুদ্ধংদেহী অবস্থায় দাঁড়িয়ে যায়। তাদের হাতে ছিল বাঁশের লাঠি, দা, কোদাল, শাবল, ঢাল, বোমা, রাইফেল, বন্দুক প্রভৃতি। এই অপচেষ্টা রুখে দেয়ার জন্যে বিগরদানায় পুরুষ ও মহিলা সমিতির সদস্যরা হরিণখোলায় জড়ো হন। দারুণমল্লিক, নোয়াই ও সংলগ্ন গ্রামগুলোর সমিতি সদস্যদের এসে জড়ো হন। এক পর্যায়ে তাাঁরা মিছিল করে ওয়াজেদ বাহিনীর কাছাকাছি যায়। আর যাবে কোথায়! মিছিলকারীদের উপর বোমা ছোঁড়া হয়। মিছিলকারীরা হকচকিয়ে যান। পরিস্থিতি সামলে নিয়ে নারীদের সামনে দিয়ে পুরুষেরা পিছনে থেকে মিছিলটি নিয়ে সামনে এগুনোর চেষ্টা করে। ভাবনাটি ছিল নারীদের উপর হামলা করতে তারা নিশ্চয়ই একটু ভাববে। কাজও হয়। লাঠিয়ালরা সরাসরি আক্রমণ না করে মিছিলকারীদের সামনে এসে হুমকি দেয়। লাঠিয়ালরা বলে, ‘এখানে কোন মিছিল-ঠিছিল চলবে না। আমরা মারতে এসেছি। মিছিল করলে, আমাদের কাজে বাধা দিলে তোমাদেরকে গুলি করব, মেরে ফেলবো। তোমরা চলে যাও।’ তখন মিছিলটি ধীরে ধীরে ফিরে যায়।
প্রায় একই সময়ে উত্তর দিকে আর একটি জমায়েত হয়। এই জমায়েতে ভ‚মিহীন নেতা আবুল সর্দার, নূর আলী গাজী ছিলেন। তাঁরা মিছিল বের করেন। এই মিছিলটিরও সামনে ছিল বিগরদানা মহিলা সমিতির সদস্যরা। মিছিলটি মালেক সর্দারের বাড়ি পার হয়ে গেলে ওয়াজেদের লাঠিয়ালরা বাধা দেয়। এখানেও একই ধরনের হুমকি-ধমকি। মিছিলকারীরা তাদের কথায় কান দেয়নি। ‘নোনা-পানির চিংড়ি চাষ চলবে না’, ‘নোনা পানি ঢোকানো চলবে না’ প্রভৃতি শ্লোগান দিয়ে মিছিলটি নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে। লাঠিয়ালরা আর বসে থাকেনি। মিছিলকারীদের লক্ষ্য করে প্রথমে বোমা ছোঁড়ে। ভারী বৃষ্টি এবং কাদা হওয়ায় মাটিতে পড়ে প্রথমে কয়েকটি বোমা বিষ্ফোরিত হয়নি। বিগরদানার মহিলা সমিতির সদস্যরা এগিয়ে যেতে থাকেন। নূর আলী গাজীর স্ত্রী আনোয়ারা গাজী, রূপবান, করুণা, উর্মিলা, সীমাঙ্গিনী, হরিদাসী প্রমুখেরা বন্দুকধারীদের সাথে তর্ক জুড়ে দেন। এক পর্যায়ে আবারও একের পর এক বোমার বিষ্ফোরণ ঘটে। বন্দুকের গুলিও ছোঁড়া হয়। একটি গুলি সরাসরি মিছিলকারী ভূমিহীন নেত্রী করুণাময়ী সরদারের মাথায় আঘাত হানে। আহত হয় শতাধিক। এলাকায় ব্যাপক ভাঙচুর, নারীদের লাঞ্ছনা-শ্লীলতাহানিরও ঘটনা ঘটায়। করুণাময়ী সরদারের মাথার অংশ বিশেষ গাছের ডালে ঝুলতে দেখা গেলেও তাঁর মরদেহটি খুঁজে পাওয়া যায়নি।
এই ঘটনায় প্রথম পর্যায়ে পুলিশ ভূমিহীনদের পক্ষে মামলাই গ্রহণ করতে চায়নি। বিস্ময়কর হচ্ছে, ওয়াজেদ বিশ্বাসের লোকেরা ‚ ভূমিহীনদের ওপর হামলে পড়ে খুন ও মারধরের ঘটনা ঘটালেও পুলিশ এসে সেই ভূমিহীনদের তাড়িয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে, তাদেরকে গ্রেফতার করেছে। পরবর্তীতে পুলিশের উর্ধতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপে ওয়াজেদ আলী বিশ্বাসকে আসামী করে একটি মামলা হয়। নিজেরা করি’র সহযোগিতায় সতেরো বছর ধরে এই মামলা চলে। করুণাময়ী সরদার হত্যা মামলায় আদালত বারো জনকে সশ্রম যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও প্রত্যেককে দশ হাজার টাকা জরিমানার আদেশ দেয়া হয়। এছাড়া বিষ্ফোরক দ্রব্য মামলায় আট জনকে সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে ছয় মাসের দণ্ড দেয়া হয়। সেই সাথে লাশ গুমের দায়ে দুই আসামীকে দণ্ড দেয়া হয়।
নোনা পানির চিংড়ি চাষের বিরোধিতা করে খুলনা অঞ্চলে অনেকেই হত্যার শিকার হয়েছেন। কিন্তু মামলা ও বিচার হওয়ার উদাহরণ এই একটি। আজ তাঁর ত্রিশতম হত্যাবার্ষিকীর দিন। করুণাময়ী সরদার নোনা পানির চিংড়ি চাষ বিরোধী আন্দোলনের প্রতীক। পাইকগাছার দেলুটি ইউনিয়নের এই নারী করুণাময়ীকে এলাকাবাসী আজও মনে রেখেছে। হরিণখোলায় তাঁর স্মরণে নির্মিত বেদীমূলে এলাকাবাসী পুষ্পস্তবক তুলে দিয়ে এই নারীকে স্মরণ করবে; পাশাপাশি শপথ নেবে অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর।
গৌরাঙ্গ নন্দী : সাংবাদিক, সাহিত্যিক