নেপথ্যে পানি নিষ্কাশনের খালগুলোকে হত্যাচেষ্টা
মামুন খান
ভাদ্র মাসের শেষ দিবসের প্রথম প্রহর থেকে শুরু করে দুপুর ১২ টা পর্যন্ত বিভিন্ন সময় হওয়া বৃষ্টিপাতের পরিমাণ গত পাঁচ বছরের রেকর্ড ভেঙ্গেছে। এই দিনে ১০ ঘন্টায় ১শ’ ৪১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে। মধ্যরাত থেকে আরম্ভ হওয়া ভারী বর্ষণে দুপুর পর্যন্ত নগরীর বিভিন্ন রাস্তাঘাট পানিতে ডুবে ছিল। মানুষের ঘর-বাড়িতেও পানি প্রবেশ করেছিল। টানা কয়েক ঘন্টার জলাবদ্ধ পরিস্থিতিতে শহরের বিভিন্ন প্রান্তের নানা শ্রেণী পেশার মানুষ চরম দুর্ভোগের মধ্যে পড়েছিলেন।
খুলনা আবহাওয়া অফিস কর্তৃপক্ষ বলছেন, এর আগে গত ২০১৬ সালের ২২ আগস্ট ২৪ ঘন্টায় ২শ’৭১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছিল। অন্যদিকে, গতকাল বৃহস্পতিবার ভোর ৬ টা থেকে পূর্ববর্তী ২৪ ঘন্টায় ১শ’৪৬ মিলিমিটার এবং পরবর্তী পাঁচ ঘন্টায় ১১ মিলিমিটার বর্ষণ হয়েছে। ২৯ ঘন্টায় রেকর্ড হওয়া বৃষ্টিপাত গত ৫ বছর আগে ২৪ ঘন্টায় হওয়া বর্ষার তুলনায় ১শ’১৪ মিলিমিটার কম।
শহরের নিরালা, সোনাডাঙ্গা, প্রান্তিক আবাসিক এলাকা, টুটপাড়া, পূর্ববানিয়াখামার, শিপইয়ার্ড, জিন্নাহপাড়া, মিয়াপাড়া, মৌলভীপাড়া, বাগমারা, বয়রাসহ খালিশপুর ও দৌলতপুরের বিভিন্ন সড়কে জলজট দুর্ভোগ নেমে এসেছিল। বিভিন্ন স্থানে হাঁটু সমান, আবার কোথাও তারও বেশি পরিমাণ পানি জমেছিল। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সীমানায় পানি প্রবেশ করেছিল। কয়েকটি এলাকায় মানুষের বাসার নিচতলা পর্যন্ত পানিতে সয়লাব হয়ে পড়েছিল। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাত টার দিকেও কিছু-কিছু বাড়িতে বালতিতে করে পানি অপসারণের চেষ্টা চলছিল বলে জানা গেছে।
সূত্রমতে, সকালে জলামগ্ন সড়কে যানবাহনের সংখ্যা কম ছিল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অফিস-আদালতগামী মানুষ যাতায়াতে চরম দুর্ভোগে পড়েছিলেন। বিভিন্ন বাজারের ক্রেতা-বিক্রেতাও ভীষণ বিড়ম্বনায় ছিলেন। ড্রেন উপচে পড়া নোংরা পানি মাড়িয়ে এবং বৃষ্টিতে ভিজে অনেকে গন্তব্যে পৌঁছান। যদিও তাদেরকে অন্যদিনের তুলনায় রিক্সা, ইজিবাইক ও মাহেন্দ্রর ভাড়া বেশি গুণতে হয়েছে। এএসসি ও সমমানের পরীক্ষার প্রথম দিনে কেউ-কেউ যথাসময়ে কেন্দ্রে পৌঁছাতে ভীষণ বেগ পেয়েছেন।
এদিকে, জলজট পরিস্থিতিতে নগরীর ১৫ থেকে ২০ টি কাঁচা বাজার কয়েক ঘন্টা বন্ধ ছিল। ভোর ৬ টা কিংবা সকাল ৭ টা থেকে শুরু হওয়া বাজারগুলোতে কেনা-বেঁচা আরম্ভ হতে ১০ টা থেকে ১২ টা বেজে যায়। বাজারে ক্রেতা-বিক্রেতাদের উপস্থিতি ছিল নামেমাত্র। কোনো-কোনো খুচরা ব্যবসায়ী বৃষ্টির কারণে সকালে আড়তে মালামাল কিনতে যাননি। খুলনা ২৬ বাজার খুচরা কাঁচামাল ব্যবসায়ী সমিতি’র সাধারণ সম্পাদক মোঃ নিজাম উদ্দীন কালু এ তথ্য জানান।
খুলনা সিটি কর্পোরেশন-কেসিসি’র কনজারভেন্সি শাখা থেকে জানা গেছে, বাস্তহারা এলাকার একটি খালে দখলবাজদের কালো থাবা পড়েছে। তাদের আগ্রাসনে খালটি সরু হয়ে মরতে বসেছে। ওই খাল দিয়ে সাত-আটটি ওয়ার্ডের পানি নিষ্কাশন হয়। সেখান হতে পানি ময়ূর নদী হয়ে বটিয়াঘাটার আলুতলা এলাকার ১০ গেট দিয়ে রূপসা নদীতে নিষ্কাশিত হয়। ময়ূর নদও গভীরতা হারিয়ে ফেলেছে। ময়ূরের দুষিত ও দুর্গন্ধময় জলও উপচে পড়ছিল। অর্ধশত ড্রেনের উন্নয়ন কাজ চলমান থাকায় সেগুলো দিয়ে পানি নিষ্কাশন বন্ধ রয়েছে। অন্য নর্দমাগুলোতে পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা নিয়মিত ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করলেও অসচেতন মানুষেরা বিভিন্ন স্থানের ড্রেনে গৃহস্থলী, বাজার ও নির্মাণ সামগ্রীর বর্জ্য ফেলে অগভীর করে ফেলেছে। ওই সব ড্রেন দিয়ে পানি উপচে পড়ে রাস্তা সয়লাব হয়েছিল। অন্যদিকে, জোয়ারের সময় নদীর পানির উচ্চতা বাড়ায় রূপসা নদী সংলগ্ন শিপইয়ার্ড এলাকা ও ভৈরব নদ সংলগ্ন খালিশপুরের কয়েকটি এলাকায় বৃষ্টির পানির সাথে নদীর পানি যুক্ত হয়ে পরিস্থিতি দুর্ভোগময় করে তোলে। অন্তত সাত-আট ঘন্টা নগরবাসীকে জলজট বিড়ম্বনা পোহাতে হয়েছে। দুপুরের পর থেকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করে।
যদিও বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (বা-পাউবো) বিভাগ-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ আশরাফুল আলম বৃহস্পতিবার জোয়ারের সময় নদ-নদীর পানি স্বাভাবিক ছিল বলে দাবি করেছেন। তিনি বলেন, জোয়ারের সময় সমুদ্র পৃষ্ঠের তুলনায় নদীর পানি স্বাভাবিকভাবে তিন মিটার বেশি উচ্চতায় প্রবাহিত হয়।
খুলনা আবহাওয়া অফিস কর্তৃপক্ষ বলছেন, বৃহস্পতিবার মধ্যরাত এক টা থেকে ভোর ৬ টা পর্যন্ত একপ্রকার লাগাতারভাবে ভারী বর্ষণ হয়েছে। এরপর দুপুর ১২ টা পর্যন্ত হালকা থেকে মাঝারি মানের বৃষ্টিপাত হয়েছে। দুপুর দেড় টার পর থেকে সূর্যের মুখ দেখা গেছে। তবে, সূর্য লুকোচুরি খেলছিল। সূর্যালোকে উত্তাপ ছিল না। পরবর্তীতে দুপুর সাড়ে তিন টার পর থেকে প্রকৃতি আলোকজ্জ্বল হয়েছিল।
খুলনা সিটি কর্পোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা মোঃ আব্দুল আজিজ বলেন, ইতিমধ্যে ২২ টি খাল অবৈধ দখলবাজদের কবল হতে কর্তৃপক্ষ উদ্ধার করেছেন। ওই খালগুলোসহ মযূর নদের খনন কাজ শেষে আগামী এক বছর পর নগরবাসীকে এরকম জলজট দুর্ভোগে আর পড়তে হবে না।
খুলনা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আমিরুল আজাদ গত রাতে বলেন, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপের কারণে আকাশে গভীর সঞ্চালনশীল মেঘমালা তৈরি হয়েছিল। লঘুচাপটি ভারতের মধ্যপ্রদেশের মধ্যাঞ্চলসহ তৎসংলগ্ন এলাকা দিয়ে অতিক্রম করে গেছে। তবে, মৌসুমী বায়ুর সক্রিয়তা রয়েছে। আকাশে হালকা মেঘ ভাসছে। আজ শুক্রবার মেঘ-রোদ্দুরের লুকোচুরির পাশাপাশি বিভিন্ন স্থানে হালকা থেকে মাঝারি মানের বর্ষণের সম্ভাবনা রয়েছে।