জন্মভূমি ডেস্ক : বাগেরহাটে মোরেলগঞ্জ উপজেলার নামকরণ হয়েছে ইংরেজ নীলকর রবার্ট মোরেলের নামে। ১৪২ বছর আগে দোর্দণ্ড প্রতাপশালী এ নীলকর প্রতিষ্ঠা করেন এক নীলকুঠি। সে সময় নীলচাষীদের ওপর অত্যাচারের প্রতীক হয়ে উঠেছিল এই কুঠিটি। ঐতিহাসিক এ কুঠিকে পুরাকীর্তি প্রত্নসম্পদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। সম্প্রতি অধিদপ্তর পরিচালিত প্রত্নতাত্ত্বিক এক অনুসন্ধান জরিপের ভিত্তিতে রবার্ট মোরেলের নীলকুঠিসহ ২৫৬টি ঐতিহাসিক স্থাপনা ও পুরাকীর্তিকে নতুন করে প্রত্নসম্পদ হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়। এসব স্থাপনা ও পুরাকীর্তির মধ্যে রয়েছে প্রত্নতাত্ত্বিক ঢিবি, মসজিদ, মন্দির, মাঠ, সমাধিসৌধ, সেতু, আবাসিক স্থাপনা, জমিদারবাড়ি, নীলকুঠি, কাচারিবাড়ি, প্রাচীন জলাশয় ও দিঘি ইত্যাদি।
দেশের বিভিন্ন এলাকায় গত অর্থবছরে পরিচালিত এ জরিপে চিহ্নিত পুরাকীর্তিগুলোর বিভাগভিত্তিক তালিকা প্রকাশ করেছে অধিদপ্তর। এর মধ্যে খুলনা ও বরিশাল বিভাগে অনুসন্ধান চালিয়ে প্রাথমিকভাবে ১২ ক্যাটাগরিতে ৫৭টি ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও প্রত্নস্থলকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। বাগেরহাটে রবার্ট মোরেলের কুঠি ছাড়াও ঐতিহাসিক এসব নিদর্শনের মধ্যে রয়েছে নড়াইলের হাটবাড়িয়া জীতেন্দ্র নাথ রায়ের জমিদারবাড়ি।
রবার্ট মোরেলের কুঠিটি স্থানীয়ভাবে মোড়ল সাহেবের বাড়ি নামে পরিচিত। উপজেলা সদর থেকে ২ কিলোমিটার দূরে উপজেলা ভূমি অফিসের পাশে অবস্থিত এই কুঠি। স্থানীয়ভাবে নীল বিদ্রোহের সময়কার নানা ঘটনাবলিরও সাক্ষী।
রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের তত্ত্বাবধানে নওগাঁ জেলার সদর উপজেলা এবং মান্দা উপজেলায় প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানমূলক জরিপ পরিচালনা করে ভাঙা মসজিদ, মাড়ওয়ারি জমিদারবাড়ি, শ্মশান মন্দির গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নস্থল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। মাঠ গবেষণার মাধ্যমে আবিষ্কৃত নিদর্শনের ঐতিহাসিক তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ, অনুসন্ধান, স্থাপনা ও নিদর্শনের রেখাচিত্র গ্রহণ, আলোকচিত্র ধারণ, ভূমিসংক্রান্ত তথ্যাদি সংগ্রহ, নিদর্শন সম্পর্কে স্থানীয়দের মতামত গ্রহণ করা হয়েছে।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের উপপরিচালক (প্রশাসন) মো. লিয়াকত আলী বলেন, ‘২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান জরিপে সর্বমোট ২৫৬টি ঐতিহাসিক স্থাপনা ও পুরাকীর্তি চিহ্নিত করা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে এসব স্থাপনা ও পুরাকীর্তিকে প্রত্নসম্পদ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।’
ঢাকা ও ময়মনসিংহ বিভাগে পরিচালিত প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ ও অনুসন্ধানে মোট ৪৬টি প্রত্নস্থল নথিভুক্ত হয়েছে। এর মধ্যে কিশোরগঞ্জের সদর ও হোসেনপুর উপজেলায় বেশকিছু প্রত্নস্থল চিহ্নিত হয়েছে। শুধু কিশোরগঞ্জ সদরেই চিহ্নিত হয়েছে ১০টি। এ দুই উপজেলায় প্রত্নস্থলের তালিকায় নতুন করে অন্তর্ভুক্ত স্থাপনাগুলো হলো খরমপট্টি পুরাতন ভবন, হরিহরদাস পরশুরাম সাহার বাড়ি, কবি চন্দ্রাবতীর বাড়ি, অশ্বিনী কুমার মজুমদারের বাড়ি, সগড়া স্বর্গীয় রামকুমার পাতি স্মৃতি মন্দির ইত্যাদি। এছাড়া জগৎচন্দ্র ভৌমিকের বাড়ি, কালী চন্দ্র ভট্টাচার্যের বাড়ি, গাংগাটিয়া জমিদারবাড়ির মতো ১৫০ বছরের বেশি সময়ের পুরনো কিছু স্থাপনাও এ তালিকায় রয়েছে।
এর মধ্যে গাংগাটিয়া জমিদারবাড়িটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল ব্রিটিশ শাসনামলের শুরুর দিকে। বাড়ির প্রতিষ্ঠাতা ভোলানাথ চক্রবর্তী। অন্যান্য জমিদারবাড়ির মতো এটি এখনো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়নি। ভোলানাথ চক্রবর্তীর বংশধররা এখনো এ বাড়িতে বসবাস করছে। বাড়িটি সংরক্ষণে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।
এছাড়া রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের মধ্যে নওগাঁ সদর এবং মান্দা উপজেলার প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানমূলক জরিপ পরিচালনা করা হয়। সেখানে প্রাচীন নিদর্শনগুলোর মধ্যে ভাঙা মসজিদ, মাড়ওয়ারি জমিদারবাড়ি, শ্মশান মন্দির ইত্যাদিকে গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নস্থল চিহ্নিত করা হয়েছে।
এর মধ্যে নওগাঁর ভাঙা মসজিদটি অবস্থিত নিয়ামতপুর উপজেলার ধর্মপুর গ্রামে। প্রাচীন স্থাপত্য রীতিতে নির্মিত মসজিদটির বয়স এখনো নির্ধারণ করা যায়নি। তবে ধারণা করা হয়, এর বয়স অন্তত ৪০০-৫০০ বছর। ভবনটি ব্যবহারের অনুপযুক্ত হয়ে পড়ায় স্থানীয়রা এখানে এখন আর নামাজ পড়েন না।
প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ ও অনুসন্ধানে প্রত্নস্থলের পাশাপাশি অনুসন্ধানে চিহ্নিত হয়েছে ১৭টি পুরাকীর্তি। গত অর্থবছরে চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের আওতায় কুমিল্লা জেলার আদর্শ সদর ও বুড়িচং উপজেলায় প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ এবং অনুসন্ধান পরিচালনা করে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। এই জরিপে কুমিল্লা জেলার আদর্শ সদর উপজেলায় ৬৯টি, বুড়িচং উপজেলায় ২৭টি এবং চট্টগ্রাম জেলার কর্ণফুলী উপজেলায় ১১টি, আনোয়ারা উপজেলায় ২৬টি ও পটিয়া উপজেলায় ১৭টি পুরাকীর্তি শনাক্ত ও নথিভুক্ত করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে ধনঞ্জয়ের মঠ, লেয়ারচর লক্ষ্মী গোবিন্দ মন্দির, জগৎপুর মোল্লাবাড়ী প্রাচীন টিবির ওপরে গৌরীপট্টসহ শিবলিঙ্গ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু চিহ্নিত করলেই হবে না। এসব প্রত্নস্থল ও প্রত্নসম্পদকে যথাযথ প্রক্রিয়ায় সংরক্ষণও করতে হবে। শুধু সংরক্ষণ ঘাটতির কারণে দেশের অনেক প্রত্নস্থল ও প্রত্নসম্পদ এরই মধ্যে নষ্ট হয়ে পড়েছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক একেএম শাহনেওয়াজ বলেন, ‘সারা দেশে অনেক প্রত্নসম্পদ রয়েছে। প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ অনুসন্ধানের মাধ্যমে এসব প্রত্নসম্পদ চিহ্নিত করার পাশাপাশি এর সঠিক সংরক্ষণ ব্যবস্থাও নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে একাডেমিক বিশেষজ্ঞদের দায়িত্ব দিয়ে এসব প্রত্নসম্পদের দেখভাল করতে হবে। পাশাপাশি জাতীয় বাজেটেও প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরকে গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ খনন ও সংরক্ষণ প্রক্রিয়ায় যথেষ্ট অর্থের সংকুলান প্রয়োজন।’