জন্মভূমি ডেস্ক : সরকারি-বেসরকারি সাতটি ব্যাংক গত বছরের শেষে প্রভিশন রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। এসব ব্যাংকের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২৪ হাজার ১৮৯ কোটি টাকায়, যা ২০২২ সালের একই সময় আট ব্যাংকে ছিল ১৯ হাজার ৪৮ কোটি টাকা। এক বছরে ঘাটতি বেড়েছে পাঁচ হাজার ১৪১ কোটি টাকা। তবে সেপ্টেম্বর প্রান্তিকের তুলনায় ডিসেম্বরে চার হাজার ৬৬৫ কোটি টাকা ঘাটতি কমেছে। সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ৯টি ব্যাংকে ঘাটতি ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য পাওয়া যায়।
ব্যাংকগুলো হলোÑঅগ্রণী ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক ও প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক।
নিয়ম অনুযায়ী, ঋণের শ্রেণিমান বিবেচনায় ব্যাংকগুলোর মুনাফা কিংবা শেয়ারহোল্ডার মূলধন থেকে একটি অংশ আলাদা করে রাখতে হয়, যাকে প্রভিশন বলা হয়। আমানতকারীদের অর্থের নিরাপত্তা দিতে ব্যাংকগুলোর জন্য আন্তর্জাতিকভাবে এ ধরনের ব্যবস্থা রয়েছে। খেলাপি ঋণ বাড়লে প্রভিশন সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা বাড়ে। আর প্রভিশন ঘাটতি বাড়লে ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি বেড়ে যায়। বর্তমানে অশ্রেণিকৃত ঋণের ধরন অনুযায়ী শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশ পর্যন্ত প্রভিশন রাখতে হয়। খেলাপি ঋণের প্রথম পর্যায় ‘সাব-স্ট্যান্ডার্ড’ ঋণে রাখতে হয় ২০ শতাংশ। দ্বিতীয় পর্যায় বা ‘ডাউটফুল’ ঋণের বিপরীতে রাখতে হয় ৫০ শতাংশ। এছাড়া ‘মন্দ’ মানে শ্রেণিকৃত ঋণের বিপরীতে রাখতে হয় শতভাগ।
জানা যায়, কিছু ব্যাংক প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত অর্থ নিরাপত্তা সঞ্চিতি হিসেবে রেখে দেয়ায় সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতে ঘাটতির পরিমাণ কিছুটা কম। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতের সার্বিকভাবে নিরাপত্তা সঞ্চিতির ঘাটতি ছিল ১৯ হাজার ২৬১ কোটি টাকা। ডিসেম্বর পর্যন্ত সামগ্রিকভাবে ব্যাংক খাতে ৯৮ হাজার ৯৪১ কোটি টাকা প্রভিশন রাখার কথা ছিল। তবে সংরক্ষণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭৯ হাজার ৬৮০ কোটি টাকায়।
নিয়ম অনুযায়ী, প্রভিশন ঘাটতিতে থাকা কোনো ব্যাংক লভ্যাংশ দিতে পারে না। আবার ঘাটতি থাকলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ওই ব্যাংকের চার্জ বেশি লাগে। এসব কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন ছাড় দিয়ে আর্থিক বিবরণী ভালো দেখানোর সুযোগ দিচ্ছে। প্রভিশন ঘাটতি থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে বিলম্বে ঋণ পরিশোধ থাকা ডেফারেল সুবিধার কারণে আর্থিক বিবরণীতে দেখাতে হচ্ছে না। এতে করে বিনিয়োগকারী, আমানতকারী ও শেয়ারহোল্ডাররা অনেক ক্ষেত্রে ব্যাংকটির আসল চিত্র জানতে পারছে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে দেশের ব্যাংক খাতে সবচেয়ে বেশি প্রভিশন ঘাটতিতে রয়েছে বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক। বিভিন্ন দুর্নীতি এবং অনিয়মের কারণে বেশ আলোচিত এই ব্যাংকটি। তাই অন্যদের তুলনায় আমানত সংগ্রহ এবং ঋণ আদায় বেশ পিছিয়ে তারা। ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ৩৬৮ কোটি টাকায়। খেলাপিসহ অন্যান্য ঋণের বিপরীতে ব্যাংকটির প্রভিশনের প্রয়োজন ছিল ১৩ হাজার ৫৮২ কোটি টাকা। কিন্তু ব্যাংকটি এক হাজার ৮৮৪ কোটি টাকা রাখতে সক্ষম হয়েছে। ফলে ঘাটতি রয়েছে ১১ হাজার ৬৯৮ কোটি টাকা।
ঘাটতির তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংক। ডিসেম্বরে ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে পাঁচ হাজার ১৯৫ কোটি টাকায়। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে আরেক রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংক। এ সময়ে ব্যাংকটির ঘাটতি দাঁড়িয়েছে চার হাজার ৩৪০ কোটি টাকায়। রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালি ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দুই হাজার ২৭৩ কোটি টাকা। এছাড়া বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ৩৮৫ কোটি, স্টান্ডার্ড ব্যাংকের ২৩১ কোটি এবং প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৬৭ কোটি টাকায়।
এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, ব্যাংকগুলো তাদের বিতরণ করার ঋণ আদায় করতে ব্যর্থ হচ্ছে। এজন্য অতিরিক্ত প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হচ্ছে। এছাড়া ব্যাংকগুলোর মন্দ ঋণ দিন দিন বাড়ছে। এসব ঋণে শতভাগ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। দেশে আর্থিক সংকট থাকার কারণে বর্তমানে আমানতের প্রবৃদ্ধি তেমন একটা নেই। পাশাপাশি ব্যাংকে তারল্য সংকটও রয়েছে। এ কারণে হয়তো ব্যাংকগুলো প্রভিশন সংরক্ষণ করতে পারছে না।
এদিকে ২০২৩ সাল শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ হাজার কোটি টাকায়, যা বিতরণকৃত মোট ঋণের ৯ শতাংশ। ২০২২ সাল শেষে ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল এক লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা বা ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ। সে হিসাবে এক বছরে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২৪ হাজার ৯৭৭ হাজার কোটি টাকা বেড়েছে।