মোল্লা আব্দুর রব বাগেরহাট : এবছরেও আগাম মধু আহরণের পাস সংগ্রহে আগ্রহ নেই পূর্ব সুন্দরবনের মৌয়ালদের। গত বছর (২০২২ সাল) থেকে মধু আহরণের মৌসুম ১৫ দিন এগিয়ে ১ এপ্রিলের পরিবর্তে ১৫ মার্চ নির্ধারণ করে বনভিাগ। কিন্তু নতুন এই নিয়মে মৌসুম শুরুর ১০দিন পার হলেও শনিবার (২৫মার্চ) পর্যন্ত শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জ থেকে একটি পাসও সংগ্রহ করেননি মৌয়ালরা। তাছাড়া, বনবিভাগ গত বছর থেকে রাজস্বের পরিমান দ্বিগুণ বৃদ্ধি করায় হতায় পড়েছেন তারা।
আগাম পাস গ্রহণ না করার কারণ হিসেবে পূর্ব বনবিভাগের অভিজ্ঞ মৌয়াল ও ব্যবসায়ীরা জানান, এপ্রিলের আগে পূর্ব সুন্দরবনে পূর্ণাঙ্গ মৌচাক তৈরী হয় না। এর আগপর্যন্ত মৌমাছিরা চাক (বাসা) তৈরী ও মধু সংগ্রহে ব্যস্ত থাকে। এই সময় চাকে কোনোরকম আঘাত করলে মৌমাছিরা অন্যত্র চলে যায়। চাকে পরিপূর্ণ মধু পাওয়া যায় না। ফলে ১ এপ্রিল থেকেই পূর্ব সুন্দরবনে মধু আহরণের সঠিক সময়। গত বছর বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় মধুও কম হয়েছে। কিন্তু এবার মৌসুমরে শুরুতে কয়েক দফা বৃষ্টি হওয়ায় মধু বেশি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানান মৌয়ালরা।
মৌয়াল ও মধু ব্যবসায়ীদের এই যুক্তির সঙ্গে একমত পোষন করে বনবিভাগ জানায়, সুন্দরবনের শরণখোলা ও চাঁদপাই এলাকা নিয়ে পূর্ব বনবিভাগ এবং খুলনা ও সাতক্ষীরা নিয়ে হচ্ছে পশ্চিম বনবিভাগ গঠিত। এই দুই বিভাগের বনাঞ্চলের ভৌগোলিকগত অনেক পার্থক্য রয়েছে। একারণে দুই অঞ্চলে সমগোত্রের গাছপালাও একই রকম জন্মায় না। সুন্দরবনে যে কয়টি প্রজাতির ফুলের মধু পাওয়া যায়, তার মধ্যে খলসি ও গরাণ ফুলের মধু উন্নতমানের। পশ্চিম বিভাগের এই খলসি ও গরাণ প্রজাতির গাছ আাগাম ফুল আসে। আর পূর্ব বনবিভাগের এসব গাছে ফুল আসে একটু দেরিতে। যে কারণে পূর্ব বিভাগের মৌয়ালদের আগাম পাস গ্রহনে আগ্রহ কম। তাছাড়া পশ্চিম বিভাগের মনে খলসি ও গরাণ মধু সংগ্রহের জন্যই মূলত আগাম সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। গত বছর থেকে ১এপ্রিলের পরিবর্তে নতুন নিয়মে ১৫ মার্চ থেকেই মধুর পাস দেওয়া শুরু হয়।
শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জ সূত্রে জানা গেছে, পূর্ব সুন্দরবন থেকে এবছর (২০২২-২০২৩ অর্থবছর) ১০৫০ কুইন্টাল মধু এবং ৩৫০ কুইন্টার মোম আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। কোনোপ্রকার প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে লক্ষ্য পূরণ হবে বলে দাবি বনবিভাগের।
শরণখোলার খুড়িয়াখারী গ্রামের মৌয়াল জামাল ফরাজী, বগী গ্রামের শাহজাহান হাওলাদার, চালিতাবুনিয়া গ্রামের রাজ্জাক তালুকদার ও নজরুল ইসলাম জানান, আগাম পাসে লাভবান হবে পশ্চিম বিভাগের মৌয়ালরা। এই সময় বনে গেলে পূর্ব বিভাগের মৌয়ালদের পুরো একটি গোন (১৫ দিনে এক গোন) লোকসান গুনতে হবে। প্রতি গোনে (১৪দিন) জনপ্রতি ৭৫০ টাকার রাজস্ব গত বছর থেকে বেড়ে হয়েছে ১হাজার ৫০০ টাকা। আনুসঙ্গিক খরচও বেড়েছে বহুগুণ। ৮ থেকে ১০ জনের একেকটি মৌয়াল দলের সব মিলিয়ে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা খরচ হয়। এসব বিবেচনা করে ১এপ্রিল থেকেই বনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা।
অভিজ্ঞাতা সম্পন্ন এসব মৌয়ালদের সঙ্গে কথা বলে আরো জানা যায়, মার্চের মাঝামাঝি পর্যন্ত বাসা তৈরী করবে মৌমাছিরা। সেই বাসায় ডিম পেড়ে বংস বিস্তারের পাশাপাশি একই সাথে বাসা তৈরী ও মধু সংগ্রহের কাজও চলমান থাকে মৌমাছিদের। এর পর বনের নানা প্রজাতির ফুল থেকে বিন্দু বিন্দু মধু সংগ্রহ করে নেই বাসা বা চাকে জমা করে। পুরো মার্চ মাসই বাসা তৈরী এবং মধু সংগ্রহে পার হয়ে যায়। এপ্রিল মাসের পর থেকেই সেসব বাসা মধু সংগ্রহের জন্য উপযোগি হয়ে ওঠে। চাকের কিছু অংশ রেখে মধু সংগ্রহ করা হয়, যাতে পরবর্তীতে মৌমাছিরা সেখানে আবার নতুন করে বাসা তৈরী করতে পারে। বাসা তৈরীর শুরুতেই যদি চাকে আঘাত বা মধু আহরণের জন্য ধোঁয়া দেওয়া হয়, তখন মৌমাছিরা পূর্ণাঙ্গ বাসা তৈরী করতে পারে না। বাধাপ্রাপ্ত হয়ে তা অন্যত্র চলে যায়। এতে মৌমাছি এবং মৌয়াল উভয়ই ক্ষতিগস্ত হয়।
মধু ব্যবসায়ী মো. রাসেল আহমেদ, জালাল মোল্লা, ফেরদৌস খানসহ কয়েকজন জানান, আগাম সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সুন্দরবনের দুই অঞ্চলের অভিজ্ঞ মৌয়াল ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে এবং বনের কোন এলাকায় কোন ফুল বেশি সে বিষয়টি ভালোভাবে খোঁজখবর নেওয়া উচিৎ ছিল বনবিভাগের। তবে, এবছর মৌসুমের আগে বৃষ্টি হওয়ায় গত বছরের তুলনায় বেশি মধু আহরণের সম্ভাবনা রয়েছে।
পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা ষ্টেশন কর্মকর্তা (এসও) মো. আসাদুজ্জামান জানান, ১৫ মার্চ মধু সংগ্রহের অনমোতি দিলেও মৌয়ালরা কেউ পারমিট করেননি। কারন এ অঞ্চলের বনে সাধারণত এপ্রিলের পর থেকেই মধু পওয়া যায়। তাই মৌয়ালরা সবাই এক হয়ে ১ এপ্রিল পারমিট করে সুন্দরবনে মধু সংগ্রহে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
পূর্ব বনবিভাগের শরণখোলা রেঞ্জের সহকারী বনসংরক্ষক (এসিএফ) মো. শামসুল আরেফিন বলেন, সুন্দরবনে মধু কম-বেশি হওয়া অনেকটা বৃষ্টি এবং অঞ্চলভেদে ফুল আগে-পরে আসার ওপর নির্ভর করে। এবার আগাম বৃষ্টি হওয়ায় আশা করা যায় মধু বেশি হবে।
এসিএফ আরো জানান, সংশ্লিষ্ট বন অফিস থেকে ১৪দিনের পারমিট নিয়ে বনে প্রবেশ করবেন মৌয়ালরা। পাস নিতে হলে অনুর্ধ্ব ২০০মন ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন বৈধ বিএলসি ধারী নৌকার মালিক হতে হবে তাদের। কোনো মৌয়াল মধু আহরণের জন্য মৌমাছি তাড়াতে অগ্নিকুন্ড, মশাল বা অনুরূপ কোনো দাহ্য পদার্থ এবং রাসায়নিক দ্রব্যাদি ব্যবহার করতে পারবেন না। এগুলোসহ ৯টি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এই নির্দেশনা অমান্যকারীর বিরুদ্ধে বন আইনে শাস্তির বিধারনও রয়েছে।