ভূমিকা: প্রাচীনকাল থেকেই বাংলার মানুষ গান রচনা করেছে, গান গেয়েছে। বাংলায় পাল শাসনামলে রচিত চর্যাপদের কবিরাও ছিলেন মূলত গান রচয়িতা। তবে বাংলা গানে সম্রাটের আসনে সমাশীন নজরুল ইসলাম।
গানের মালা: ৯৫টি সংগীত সমৃদ্ধ গ্রন্থটি ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের ২৩ অক্টোবর (কার্তিক ১৩৪১) প্রকাশ করেন গুরুদাস চট্রোপাধ্যায় অ্যান্ড সন্স। এখানে স্থান পেয়েছে, আমি সুন্দর নহি জানি, আধো-আধো বোল, ভুল করে যদি ভালোবেসে থাকি, প্রিয় এমন রাত যেন যায় না বৃথাই, বল্ সখি বল্ ওরে সরে যেতে বল্, নিশি না পোহাতে যেয়ো না যেয়ো না, চম্পা পারুল যুথী টগর চামেলি।
গীতি শতদল: এই গ্রন্থটির প্রকাশক ছিলেন ডি এম লাইব্রেরি। প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯৩৪ সালের এপ্রিলে (১৩৪১ বঙ্গাব্দের বৈশাখ)। নজরুল এই গ্রন্থের প্রারম্ভে ‘দুটি কথা’ শীর্ষক ভূমিকায় লেখেন “গীতি শতদলে’র সমস্ত গানগুলিই গ্রামোফোন ও স্বদেশী মেগাফোন কোম্পানীর রেকর্ডে রেখাবদ্ধ হয়ে গিয়েছে। এই গ্রন্থে মোট ১০১টি গান ছিল। যার কয়েকটি হল- শুকনো পাতার নূপুর পায়ে, চমকে চমকে ধীর ভীরু পায়, গত রজনীর কথা পড়ে মনে, পলাশ ফুলের গেলাস ভরি।
বুলবুল: বিখ্যাত ইসলামগীতি সংকলন বুলবুল ১৫ নভেম্বর ১৯২৮ (আশ্বিন, ১৩৩৫) তারিখে (১ম সংস্করণ)। প্রকাশক ডি এম লাইব্রেরি, কলকাতা। সুরশিল্পী দিলীপ কুমার রায়কে এই গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছিলেন নজরুল। গ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৩৩৫ বঙ্গাব্দের চৈত্র মাসে। ৪৯টি গান ছিল এই সংস্করণে। এ গ্রন্থে সমাহৃত গানগুলোর মধ্যে- বাগিচার বুলবুলি তুই, কেন কাঁদে পরান কী বেদনায়, মৃদুল বায়ে বকুল-ছায়ে।
বুলবুল (২য় খন্ড): ১৩৫২ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ (মে, ১৯৫৯ ) ১৬, রাজেন্দ্রলাল স্ট্রিট, কলিকাতা-৬, এই বুলবুল (২য় খন্ড) নামীয় সঙ্গীত গ্রন্থটি প্রকাশ করেন। গ্রন্থটির পরিবেশক ছিলেন ডি এম লাইব্রেরি। গ্রন্থটিতে গান ১০১টি। কবি-পতœী প্রমীলা ইসলাম প্রকাশিকার ভূমিকায় লেখেন, “কবির আধুনিক গানগুলি সংকলন করে “বুলবুল” (২য়) প্রকাশ করা হলো। এখানে আছে বুলবুলি নীরব নার্গিস-বনে, বিদায়ের বেলা মোর ঘনায়ে আসে, যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পার নাই।
গুল বাগিচা: এই গ্রন্থটির প্রকাশক গ্রেট ইস্টার্ন লাইব্রেরি। প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয় ২৭ জুন ১৯৩৩ (১৩৪০ বঙ্গাব্দ)। কবি গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছিলেন স্বদেশী মেগাফোন-রেকর্ড কোম্পানির স্বত্বাধিকারী অন্তরতম বন্ধু জিতেন্দ্রনাথ ঘোষকে। গ্রন্থের প্রারম্ভে নজরুল ‘দুটি কথায়’ লেখেন,‘‘দুই-চারিটি ছাড়া ‘গুল-বাগিচা’র গানগুলি ‘স্বদেশী মেগাফোন রেকর্ড কোম্পানী’ রেকর্ড করিয়াছেন। তাঁহাদের এই অনুগ্রহের জন্য আমি অশেষ ঋণী। ‘গুল-বাগিচা’য় ঠুংরী, গজল দাদরা, চৈতী, কাজরী, স্বদেশী, কীর্তন, ভাটিয়ালি, ইসলামী ধর্মসঙ্গীত প্রভৃতি বিভিন্ন ঢং-এর গান রয়েছে। এই গ্রন্থে মোট ৮৮টি গান ছিল।
চন্দ্রবিন্দু: ডি এম লাইব্রেরি থেকে গ্রন্থটি ১৩৩৮ বঙ্গাব্দের আশ্বিন মাসে (সেপ্টেম্বর ১৯৩১) প্রথম প্রকাশিত হয়। গ্রন্থটি উৎসর্গ করা হয়েছিল এই লিখে, পরম শ্রদ্ধেয় শ্রীমদ্দাঠাকুর শ্রীযুক্ত শরৎচন্দ্র পন্ডিত মহাশয়ের শ্রীচরণকমলে। স্বীয় পুত্র বুলবুলের মৃত্যুর পর তিনি তাঁর প্রধানত; হাস্যরসাত্মক ‘চন্দ্রবিন্দু’ সংগীত গ্রন্থের প্রায় সব গান রচনা করেন। নিদারুণ শোকাচ্ছন্ন মতে তাঁর হাস্যরস সৃষ্টির ক্ষমতা বিস্ময়কর। এই গ্রন্থের ১৮টি গানের মধ্যে রয়েছে- আদি পরম বাণী, তুমি দুখের বেশে এলে বলে ইত্যাদি।
চোখের চাতক: চোখের চাতক প্রধানত গজল সমৃদ্ধ প্রন্থ। প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয় ২১ ডিসেম্বর ১৯২৯ (অগ্রহায়ণ ১৩৩৬)। প্রকাশক ছিলেন ডি এম লাইব্রেরি। গ্রন্থটি উৎসর্গ করা হয়েছিল কল্যাণীয়া বীণা-কণ্ঠী প্রতিভা সোমকে যিনি পরবর্তীকালে সাহিত্যিক প্রতিভা বসু নামে খ্যাত। মোট ৫৩টি গানে সমৃদ্ধ গ্রন্থটি। গজলগুলির মধ্যে আছে- কাঁদিতে এসেছি আপনারে লয়ে, মোর ঘুমঘোরে এলে মনোহর।
মহুয়ার গান: ১৫টি গানে সমৃদ্ধ এই মহুয়ার গান নামীয় ইসলামগীতি গ্রন্থটি ডি এম লাইব্রেরি থেকে ১ জানুয়ারি ১৯৩০ প্রকাশিত হয়। যার অনেক গানই অত্যন্ত জনপ্রিয়। এর মধ্যে আছে- কে দিল খোঁপাতে ধুতরা ফুল লো, এক ডালি ফুলে ওরে সাজাব কেমন করে, বউ কথা কও।
রাঙা-জবা: ১০০টি শ্যামাসঙ্গীতে সমৃদ্ধ রাঙা-জবা গ্রন্থটি প্রকাশ করেন ২৪ পরগনার রাজীবপুরের বেগম মরিয়ম আজিজ। গ্রন্থটির প্রথম প্রকাশ ১ বৈশাখ ১৩৭৩ (এপ্রিল ১৯৬৬)। নজরুল নিজের জীবনে তন্ত্র ও যোগাসাধনা করেছেন। শক্তিপূজায় তাঁর ভক্তহৃদয়ের অকৃত্রিম আকুলতা ও আর্তি এইসব গানের মধ্যে রূপায়িত। এই গ্রন্থে আছে- বলে রে জবা বল, মহাকালের কোলে এসে, ভুল করেছি ওমা শ্যামা বনের পশু বলি দিয়ে।
সুরমুকুর: সুরকুমুর মুখ্যত একটি স্বররিপি সংকলন। এই গ্রন্থে ২৭টি ইসলামগীতির স্বরলিপি আছে। স্বরলিপিকার নলিনীকান্ত সরকার। ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবরে (আশ্বিন ১৩৪১) ডি এম লাইব্রেরি থেকে প্রকাশিত গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। এ গ্রন্থে যে সকল ইসলামীতির স্বরলিপি আছে। যার মধ্যে আছে- কোথা চাঁদ আমার, নিশি ভোর হ’ল জাগিয়া, করুণ কেন অরুণ আঁখি।
সুরসাকী: সুরসাকী গ্রন্থটির প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে (আষাঢ় ১৩৩৯)। প্রকাশক কালীকৃষ্ণ চক্রবর্তী, চক্রবর্তী অ্যান্ড সন্স। বইটিতে গানের সংখ্যা ৯৯। দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৩৬১ বঙ্গাব্দের আশ্বিনে (১৯৫৪)। প্রকাশিকা প্রমীলা ইসলাম। সুরসাকীর উল্লেখযোগ্য গানের মধ্যে আছে- আজি গানে গানে ঢাকব, কত সে জনম কত সে লোক।
ইসলাম গীতিকা: ১২৭টি গান নিয়ে ইসলাম গীতিকা গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৩০ খৃষ্টাব্দে। এ গ্রন্থে ঠুংরী, হাসির গান, গজল, ধ্রূপদ, কীর্ত্তন, বাউল, ভাটিয়ালী, টপ্পা এবং খেয়ালসহ বিভিন্ন ধরনের গান রয়েছে। ইসলাম গীতিকা গ্রন্থের কয়েকটি গান ‘বনগীতি’সহ অন্য গ্রন্থেও পাওয়া যায়। এখনে আছে- অগ্রপথিক হে সেনাদল, কোন অতীতের আঁধার ভেদিয়াজাগ অনশন বন্দী।
সন্ধ্যা: এটি মূলত একটি কাব্যগ্রন্থ। এটি গ্রকাশিত হয় ১৯২৯ খৃষ্টাব্দে। কারণ এই বইয়ের সবগুলো গান নয়, দুয়েকটি গান থাকলেও এটি মূলত কবিতা সমগ্র। ২৪টি কবিতা আর গান নিয়েই এই গ্রন্থ। বাংলাদেশের রণ সংগীত “চল্ চল্ চল্, উর্ধ গগণে বাজে মাদল” এই বইতে সন্নিবেশিত হয়েছে।
বনগীতি: ৭১টি গান নিয়ে বনগীতি গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৯৩২ খৃষ্টাব্দে। গ্রন্থটি উৎসর্গ করা হয়েছিলো ভারতের অন্যতম সংগীত কলা-বিদ জমীরুদ্দিন খানকে। উৎসর্গ করার সুচনা-গানটিসহ মোট গানের সংখ্যা ৭২টি। এখানকার জনপ্রিয়গানের মধ্যে আছে- ভালোবাসার ছলে আমায়, কে নিবি ফুল কে নিবি ফুল। এছাড়া ১৯৩২ খৃষ্টাব্দে কবির ২৪টি গান নিয়ে প্রকাশিত হয় জুলফিকার, ইসলাম স্বরলিপি প্রথম প্রকাশ ১৯৩১ সালে ৩৫টি গান নিয়ে এবং সুরলিপি প্রথম প্রকাশ ১৯৩৪ সালে ৩১টি গান নিয়ে।
ইসলামী গান: নজরুলের রচিত নবী-রাসূল ও ইসলামের নিষ্ঠাবান অনুসারীদের চরিত্র-মাহাত্ম্যবিষয়ক গান মুসলিম সমাজে মহত্তম অনুপ্রেরণা হিসেবে সবাই গ্রহণ করে। এছাড়া তাঁর রচিত অসংখ্য গান মুসলমানদের বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে অনিবার্যভাবে গীত হতে থাকে। যেমন- আমার ঘরে নামাজ পড়ো আজ; নামাজ পড়ো, রোজা রাখো; মোবারক মাস; আল্লাহ ব’লে কাঁদ; সালাম লহ।
হিন্দুদের ভক্তিমূলক গান: কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যের একমাত্র কবি যিনি উপমহাদেশের প্রধান দুই ধর্মীয় সম্প্রদায়ের হিন্দু-মুসলমানকে নিয়ে যুগপৎ অসংখ্য গান লিখেছেন। এরূপ প্রায় ৮৭৫টি হিন্দু মিথকে আশ্রয় করে তিনি গান রচনা করেছেন। কেবল হিন্দু মিথাশ্রয়ী এত অধিক সংখ্যক গান রচয়িতার খোঁজ মেলা ভার। গানের মধ্যে আছে শ্রীকৃষ্ণ মুরারী গদ্যপদ্মধারী মধুবন চারী গিরিধারী ত্রিভূবন বিহারী, রাধা শ্যাম কিশোর প্রিয়তম কৃষ্ণ গোপাল বনমালী ব্রজের রাখাল নারায়নী।
মুক্তিযুদ্ধে গান: মুক্তিযুদ্ধ আর নজরুল যেন একসূত্রে গাঁথা। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যেমন নজরুলের গান বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছিল তেমন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ই তার স্বাক্ষর বহন করে। তার গানের ভাষাশৈলী, ভাবব্যঞ্জনা, সুরের উন্মাদনা ও উদ্দীপনা যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধা এবং গোটা বাংলাদেশের মানুষকে উদ্দীপ্ত করেছে, রেখেছে জাগ্রত। ‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতারে সে গান প্রচারিত হয়েছে বার বার। নয় মাস ধরে ‘একি অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিণু পল্লীজননী।
হাসির গান: কবি নজরুলের সময়কালে কৌতুক, হাস্যরস, ব্যাঙাত্মক গান তেমন শোনা যেত না। বাঙলা সাহিত্যে এ ধরণের রসাত্মক গানের বা গীতি কবিতায় নজরুল এনেছেন এক ব্যতিক্রমী ধারা। মধ্যে পুরানো বলদ নতুন বৌ, শ্যালিকা তালিকা, শ্বশুরের মেয়ে, বেয়াই-বেয়ান, প্রভৃতি কৌতুক পূর্ণ নাটিকা ‘কলির কেষ্ট’ ছাড়াও অনেক নাটকে ও উপন্যাসের মধ্যেও নজরুল ছোট ছোট কৌতুকের সমাবেশ ঘটিয়েছেন।
গানের সংখ্যা: নজরুলের গানের সংখ্যা আসলে কত তা আজও অতলান্ত; এটি গবেষণার বিষয়! তারপরও বিভিন্ন নজরুল গবেষক এ প্রসঙ্গে কি বলেছেন দেখা যাক- নজরুলের সান্নিধ্য ধন্য শিল্পী সুপ্রভা সরকার বলেন ‘কাজীদার গানের সংখ্যা পাঁচ হাজার।