# সম্পর্ক ছিন্ন নিয়ে উভয় যা বলছে
জন্মভূমি ডেস্ক
দীর্ঘ টানাপোড়েনের পর বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যকার ২৩ বছরের সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছে। স¤প্রতি জামায়াতের আমির শফিকুর রহমানের দেওয়া এক ভিডিও বক্তব্যকে ঘিরে বিষয়টি আবারও সামনে এসেছে।
বিএনপি নেতারা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে বিএনপির অভ্যন্তরে জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করার দাবি উঠছিল। বছরখানেক আগে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে অধিকাংশ সদস্য জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করার বিষয়ে মতামত দিয়েছিলেন। নানা কারণে এর বাস্তবায়ন হয়নি। তবে জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে।
জামায়াত কি বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট ত্যাগ করেছে? জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু সাংবাদিকদের বলেন, তারা (জামায়াত) তো বলেছে, আমাদের সঙ্গে তাদের আলোচনা হয়েছে এবং ঐকমত্য পোষণ করেছে। তারা আর কোনো জোট করবে না। এখানে আর বলার কী আছে।
জামায়াত জোট ছাড়ার বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপিকে জানিয়েছে কি না জানতে চাইলে টুকু বলেন, এখানে আর আনুষ্ঠানিকতার কী আছে। তাদের (জামায়াত) যা বলার তো বলে দিয়েছে।
২০ দলীয় জোটের সমন্বয়ক ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান সাংবাদিকদের বলেন, আমি জামায়াতের আমিরের বক্তব্য শুনিনি। জামায়াতের জোট ছাড়ার ডেভেলপমেন্ট সম্পর্কেও আমি কিছু জানি না। তাই এ বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না।
\ জামায়াতের আমীর ডা: শফিকের বক্তব্য \
বিএনপি নেতারা বিভিন্ন সময় জামায়াত ছাড়ার কথা বললেও জামায়াতের পক্ষ থেকে কেউ এ বিষয়ে মুখ খোলেননি। তবে স¤প্রতি এক সভায় ভার্চ্যুয়াল বক্তব্যে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের ব্যাপারে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেন জামায়াতের আমীর ডা. শফিকুর রহমান।
জামায়াত সূত্রে জানা যায়, দলের একটি ঘরোয়া ভার্চ্যুয়াল সভায় তিনি এ বক্তব্য দেন। সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে ডা. শফিকুর রহমান বলেন, আমরা এতোদিন একটা জোটের সঙ্গে ছিলাম। ছিলাম বলে আপনারা হয়তো ভাবছেন কিছু হয়ে গেছে নাকি? আমি বলি হয়ে গেছে। ২০০৬ সাল পর্যন্ত এটি একটি জোট ছিলো। ২০০৬ সালের ২৮শে অক্টোবর জোট তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। সেদিন বাংলাদেশ পথ হারিয়ে ছিলো। সেটা আর ফিরে আসেনি।
তিনি বলেন, বছরের পর বছর পর এই ধরনের অকার্যকর জোট চলতে পারে না।
এই জোটের সঙ্গে বিভিন্ন দল যারা আছেন, বিশেষ করে প্রধান দলের (বিএনপি) এই জোটকে কার্যকর করার কোন চিন্তা নাই। বিষয়টা আমাদের কাছে স্পষ্ট দিবালোকের মতো এবং তারা আমাদের সঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখন বাস্তবতা হচ্ছে নিজস্ব অবস্থান থেকে আল্লাহর উপর ভর করে পথ চলা। তবে হ্যাঁ জাতীয় স্বার্থে একই দাবিতে যুগপৎ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করবো ইনশাআল্লাহ।
বিএনপির সঙ্গে জোট নিয়ে আলোচনা হয়েছে উল্লেখ করে জামায়াতের আমীর বলেন, আমরা তাদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করেছি, এর সাথে তারা ঐকমত্য পোষণ করেছে। তারা আর কোন জোট করবে না। এখন যার যার অবস্থান থেকে সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করবো। যদি আল্লাহ আমাদের তৌফিক দান করেন তাহলে আমাদের আগামী দিনগুলোতে কঠিন প্রস্তুতি নিতে হবে এবং অনেক বেশি ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। দোয়া করেন, এসকল ত্যাগ যেনো আল্লাহর দরবারে মঙ্গলজনক হয়। এ ত্যাগের বিনিময়ে আল্লাহ পাক যেন আমাদের পবিত্র একটি দেশ দান করে। যে দেশটা কোরআনের আইনে পরিচালিত হবে।
উল্লেখ্য, ১৯৯৯ সালের ৬ জানুয়ারি জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, জামায়াতের তৎকালীন আমির গোলাম আযম এবং ইসলামী ঐক্যজোটের তৎকালীন চেয়ারম্যান শায়খুল হাদিস আজিজুল হককে সঙ্গে নিয়ে চারদলীয় জোট গঠন করেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া।
জামায়াত কি বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট ত্যাগ করেছে- জানতে চাইলে জামায়াতের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক মতিউর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ২০ দলীয় জোট থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার অফিসিয়াল কোনো ঘোষণা আমরা দিইনি। এ জাতীয় কোনো বক্তব্য আমাদের দলের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়নি।
তাহলে জামায়াতের আমিরের বক্তব্য কি তার ব্যক্তিগত? জানতে চাইলে তিনি বলেন, জোট ছাড়তে হলেও তো দলের সভা বা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে হয়। কিন্তু দলের মধ্যে এ ধরনের কোনো সভা বা আলোচনা হয়নি।
জামায়াতের একটি সূত্রের দাবি, ২০২১ সালের ৩০ অক্টোবর জাতীয় প্রেসক্লাবে এক আলোচনা সভায় জামায়াতের এক নেতার ‘২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর পুরানা পল্টনে জামায়াতের সমাবেশে হামলা ও দলটির অনুসারী কয়েকজনের মৃত্যুর জন্য বিএনপি দায়ী’ এমন বক্তব্যের প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, এই জামায়াত বাংলাদেশকে আজ এই জায়গায় নিয়ে এসেছে। এসবই জামায়াতের ফাজলামি। তার এই বক্তব্যের পর জামায়াত-বিএনপির নেতাকর্মীদের কথার বাহাস চলে। এরপর ২০২২ সালের ২ এপ্রিল জাতীয় প্রেস ক্লাবে বিএনপির প্রতীকী অনশন অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে মারধরের শিকার হয় জামায়াতের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আমির নূরুল ইসলাম বুলবুলসহ কয়েকজন কর্মী। এই দুই ঘটনার পর থেকে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের দূরত্ব আরও বাড়ে। যার ফলে জামায়াতের আমির জোট ছাড়ার ঘোষণা দেন।
ঢাকা মহানগর দক্ষিণের দায়িত্বশীল এক নেতা বলেন, রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে জোট করা। আবার রাজনৈতিক কৌশল হিসেবেই জোট ভাঙতে পারে। জামায়াত যে উদ্দেশ্যে জোট করেছিল, তা থেকে জোটের অন্য শরিক দলগুলো বহু দূরে সরে গেছে। আর একক সংগঠন হিসেবে জামায়াত এখন ব্যাপক জনপ্রিয় দল। আমরা এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চাই না।
\ ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেবে জামায়াত \
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩শ আসনেই প্রার্থী দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে জামায়াত। নিবন্ধন বাতিল হওয়া দলটি এক্ষেত্রে কৌশল হিসেবে স্বতন্ত্র প্রার্থী দেবে। আর নির্বাচনের দিন-ক্ষণ ঘোষণার আগেই ২০ দলীয় জোট ত্যাগ করবে দলটি। এজন্য দলের পক্ষ থেকে নীতিগত সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছে বলে জানা যায়।
জামায়াতের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সামনের নির্বাচনে তাদের ২০ দলীয় জোটে না থাকার বিষয়টি মোটামুটি চূড়ান্ত। তবে কৌশলগত কারণে এখনই জোট ভাঙার ঘোষণা দিচ্ছে না। জামায়াত নেতারা মনে করেন, বিএনপির পক্ষ থেকে যে অবমূল্যায়ন হচ্ছে, তা আরও গাঢ় হলে বিভাজনটা স্পষ্ট করা সহজ হবে।
স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে গাঁটছড়া বেঁধেছিল জামায়াত-বিএনপি জোট। আলাদা হলেও আওয়ামী লীগ আর বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন দুই জোটের যুগপৎ আন্দোলনেই পতন ঘটে এরশাদের। সংখ্যায় কম অথচ জামায়াতের ভোটে ভর করেই ১৯৯১ সালে সরকার গঠন করে বিএনপি। ফিরে আসে সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা। ২০০১ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে চারদলীয় জোট করে ফের ক্ষমতায় আসে বিএনপি-জামায়াত।
ঢাকা মহানগরের শীর্ষ আরেক নেতা বলেন, জামায়াত ৩০০ আসনে নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে আমরা এককভাবেই বেশি নির্বাচন করে আসছি। তাছাড়া জোট তো আসলে চিরস্থায়ী কোনো ব্যবস্থা নয়।