জন্মভূমি ডেস্ক : একজন ব্যক্তি কর পরিশোধের পর ব্যাংকে টাকা রাখলেন। ব্যাংক সেই টাকার মুনাফার ওপর ১০ ও ১৫ শতাংশ হারে কর কেটে রাখে। আবার ব্যাংকে লেনদেন ও স্থিতির ওপর আবগারি শুল্ক কাটা হয়। এতে একজন ব্যক্তিকে একই টাকার ওপর তিনবার কর দিতে হচ্ছে। এমনিতেই মানুষের সঞ্চয় ক্ষমতা কমেছে। আবার মানুষের মধ্যে ভীতির কারণে ব্যাংকে টাকা জমা রাখার প্রবণতা কমেছে। তার ওপর কর ও আবগারি শুল্ক ভীতি তো রয়েছে। এই ভীতি থেকে করদাতাকে পরিত্রাণ দিতে মুনাফার ওপর কর কমানোর প্রস্তাব করেছে বিজনেস রিপোর্টারদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ)। একই সঙ্গে পাঁচ থেকে দশ লাখ টাকা পর্যন্ত আবগারি শুল্ক প্রত্যাহারেরও প্রস্তাব করা হয়েছে।
সোমবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে জাতীয় রাজস্ব ভবন সম্মেলন কক্ষে এনবিআরের সঙ্গে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রাক-বাজেট আলোচনায় এসব প্রস্তাব দেয়া হয়। সংগঠনের পক্ষ থেকে ৩৫টি প্রস্তাবনা দেয়া হয়। প্রস্তাবনা তুলে ধরেন ইআরএফ সদস্য ও ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের বিশেষ প্রতিনিধি দৌলত আক্তার মালা। সভায় এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম সভাপতিত্ব করেন। এতে ইআরএফ সভাপতি মোহাম্মদ রেফায়েত উল্লাহ মীরধাসহ সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
সূত্রমতে, বর্তমানে ব্যাংক হিসাবে এক লাখ টাকা পর্যন্ত থাকলে তা আবগারি শুল্কমুক্ত। আর ১ লাখ থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত টাকা থাকলে ১৫০ টাকা এবং ৫ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত থাকলে ৫০০ টাকা আবগারি শুল্ক দিতে হয়। এছাড়া ১০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকায় ৩ হাজার টাকা; ১ কোটি টাকা থেকে ৫ কোটি টাকায় ১৫ হাজার টাকা এবং ৫ কোটি টাকার ওপরে থাকলে ৪০ হাজার টাকা আবগারি শুল্ক কেটে রাখে ব্যাংক। অন্যদিকে কোনো ব্যাংক হিসাবধারী ব্যক্তি রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র ব্যাংকে জমা দিলে ব্যাংক মুনাফার ওপর ১০ শতাংশ আর প্রমাণপত্র দিতে না পারলে ১৫ শতাংশ হারে কর কাটা হয়।
ঋণ জালিয়াতি ও রাজস্ব ফাঁকি রোধে প্রস্তাবনায় বলা হয়, করদাতার রিটার্ন ও ঋণ নেয়ার সময় ব্যাংকে দেয়া সম্পদ বিবরণীর মধ্যে গরমিল রয়েছে। এই সুযোগে চালক, দারোয়ান, অফিস সহায়কসহ বিভিন্ন ব্যক্তির নামে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান দেখিয়ে মোটা অঙ্কের ঋণ নেয়। বেনামি এই ঋণ আর আদায় হয় না। ঋণ অনুমোদনের আগে নির্দিষ্ট ডেটাবেজ থেকে যাতে ব্যবসায়ী বা ব্যক্তির তথ্য নেয়া বাধ্যতামূল করা যায়, সে জন্য ব্যবস্থা নেয়ার প্রস্তাব করা হয়। এতে ঋণ জালিয়াতি কমবে, রাজস্ব বাড়বে।
স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণের অংশ হিসেবে আমদানি শুল্ক ব্যবস্থার কাঠামোগত পরিবর্তন চেয়েছে ইআরএফ। প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, এখনও বাংলাদেশের ট্যারিফ এলডিসিগুলোর গড় ট্যারিফের চেয়ে বেশি। গত কয়েক বছর ধরে ট্যারিফ রেট কমিয়ে আনার কথা বলা হলেও তাতে বড় ধরনের অগ্রগতি দেখা যায়নি। এরই মধ্যে ভর্তুকি কমানোর অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক নগদ সহায়তা কমানোর কার্যক্রম শুরু করেছে। সংগঠনটি বলছে, এনবিআরকেও বিভিন্ন ধরনের ট্যারিফ ওয়াল কমানোর কাজ এই বাজেট থেকেই শুরু করা প্রয়োজন। অন্যথায় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করতে গেলে হঠাৎ শুল্ক কমিয়ে আনার ধাক্কা সামলানো কঠিন হবে। করছাড় দেয়ার ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা ও জবাবদিহি প্রয়োজন। এছাড়া প্রতি করছাড়ের আদেশের সঙ্গে কত রাজস্ব ক্ষতি হলো, তার একটা প্রাক্কলন দেয়া দরকার। জেলা ও সিটি করপোরেশনে এখন বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। সেখানে এনবিআরের বৃহৎ করদাতা ইউনিটের (এলটিইউ) মতো মিডিয়াম করদাতা ইউনিট বা এমটিইউ খোলা যেতে পারে।
সংগঠনের প্রস্তাবনায় বলা হয়, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ট্যাক্স রিটার্ন জমা দিতে ব্যর্থ হলে আয়কর আইনের সংশ্লিষ্ট ধারার কারণে অনেকে রিটার্ন জমা দিতে নিরুৎসাহিত হতে পারেন। এসব ধারা পুনর্বিবেচনার প্রস্তাব করেছে সংগঠনটি। বাড়তি দেয়া কর এমএফএসের মাধ্যমে ফেরতের ব্যবস্থা করার প্রস্তাব করেছে সংগঠনটি। যাদের করযোগ্য আয় নেই তাদের ব্যাংক সুদের ওপর কর্তন করা টাকা ফেরত দেয়া, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি, শিক্ষা ও চিকিৎসা উপকরণে কর হার ৫ শতাংশে সীমিত রাখা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প বিকাশে পৃথক রাজস্ব নীতি প্রণয়ন এবং বাজেটে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি রাজস্ব পরিকল্পনা ও তার জন্য বরাদ্দ রাখার কথা বলা হয়েছে। এছাড়া বেসরকারি প্রভিডেন্ট ফান্ডকে করমুক্ত রাখা, করপোরেট কোম্পানিগুলোর রিটার্ন দেয়ার হার এত কম কেন, তা নিয়ে এনবিআর-ইআরএফের যৌথ জরিপ চালু করা, ব্যক্তি করদাতাদের সর্বোচ্চ করহার ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ করা, ভ্যাটের হার ৭ শতাংশ করা, কাস্টমসের টাইম রিলিজ স্টাডির মতো আয়কর ও ভ্যাটেও একই রকম স্টাডি চালু করা, সব সম্ভাবনায় খাতকে বন্ডেড সুবিধা দেয়া, টাকা পাচার রোধে ট্রান্সফার প্রাইসিং আইনের দৃশ্যমান প্রয়োগ, এনবিআরে একটি মিডিয়া সেল খোলা, করদাতাকে হয়রানি রোধে অনলাইন ব্যবস্থা জোরদার করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।
সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রস্তাবনায় বলা হয়, মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সম্পর্ক রেখে ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত আয়সীমা পাঁচ লাখ টাকায় উন্নীত করার প্রস্তাব করা হয়। এছাড়া নির্ধারিত সময়ের মধ্যে রিটার্ন জমা দিতে ব্যর্থ হলে কর অব্যাহতিপ্রাপ্ত সব আয় মোট আয়ের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করা, ৪ শতাংশ হারে অতিরিক্ত কর আদায়ের বিধান কিছুটা কঠিন হয়ে গেছে। এটি পুনর্বিবেচনার প্রস্তাব করা হয়। কেননা এই কঠিন ব্যবস্থার কারণে পরবর্তীকালে অনেকেই রিটার্ন দিতে নিরুৎসাহিত হবে। উৎসে কর বিধিমালায় অনিবাসীদের সেবার আয়ের ওপর উৎসে করহার সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশর বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন। না হলে এ ব্যবস্থার কারণে বৈধপথে দেশে বৈদেশিক মুদ্রা আসা নিরুৎসাহিত হবে। এনবিআরের আয়কর, ভ্যাট ও কাস্টমস বিভাগে পৃথক হেল্পলাইন চালু করার প্রস্তাব করা হয়। মৌজা রেটে নয়, বাজার মূল্যায়ন পদ্ধতির মাধ্যমে ভূমি বা সম্পদ কর আদায় করার প্রস্তাব করা হয়।
এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম ইআরএফের প্রস্তাবগুলো বিবেচনার আশ্বাস দেন। তিনি বলেন, আমরা করজাল বাড়াতে সাধ্যমতো চেষ্টা করছি। আমি আপনাদের উৎসাহিত করতে চাই। অনেকেই স্টেজে দাঁড়িয়ে বলে আমাদের ট্যাক্স জিডিপি রেশিও কম, অন্যদিকে আবার কর অব্যাহতির আবেদন করেন। টিআইএনধারী ও রিটার্ন দাখিলের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। প্রান্তিক মানুষকে করজালের আওতায় আনতে আয়কর রিটার্ন প্রস্তুতকারী বা (টিআরপি) নিয়োগ দেয়া হবে জানিয়ে তিনি বলেন, অনেকের অভিযোগ গ্রাম-গঞ্জে এখন অনেক কোটিপতি, তারা ট্যাক্স দেন না। তাদের ধরে নিয়ে আসতে হবে। কিন্তু গ্রামে গিয়ে তাদের ধরে নিয়ে আসতে হবে কেন? টিআরপি প্রোগ্রামটা যে কোনোভাবে আমরা সফল করব। আমাদের অন্য কোনো পথ নেই।