রিপনচন্দ্র মল্লিক, মাদারীপুর : ভোজ্য তেলের দাম বাড়ায় সরিষা চাষের আগ্রহ বেড়েছে চাষীদের। চলতি মৌসুমে জেলার পাঁচটি উপজেলায় বারি, বীনা, টরি ও স্থানীয় জাতের সরিষাসহ নানা জাতের সরিষা চাষ হয়েছে। বিঘা প্রতি অন্তত ৬ মন ফলনের লক্ষ্য সংশ্লিষ্টদের। গত বছরের তুলনায় এবার ফলন ভাল হয়েছে। তবে প্রচন্ড শীত ও কুয়াশায় সরিষার উৎপাদন নিয়ে দুঃচিন্তায় রয়েছে চাষীরা। সেই সাথে সরিয়া ক্রয়ের সিন্ডিকেটের দৌরাত্মের কারণে ন্যায্য মূল্য পাওয়া নিয়ে শঙ্কিত কৃষকেরা। ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত হলে আগামীতে উৎপাদন আরো বাড়বে বলে জানিয়েছেন চাষীরা। সরিষা চাষে কৃষকদের প্রণোদনার দেওয়াসহ সব ধরনের সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে বলে জানান কৃষি বিভাগ। এদিকে জেলা কৃষি বিপনন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন বাজারের দাম নিয়ন্ত্রণে সরিষার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হবে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের বিদ্যাবাগীস গ্রামের সরিষা চাষী দুলাল হোসেন খান। এবছর তিনি দুই বিঘা জমিতে স্থানীয় জাতের ধলি সরিষা চাষ করেছেন। বিঘা প্রতি তার কয়েক ধাপে খচর হচ্ছে ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা। প্রতি বিঘায় (শুকনো) চার মণ সরিষা উৎপাদন হলেও এবার শীতে সরিষার গুটি অনেক ছোট হওয়ায় উৎপাদন নিয়ে শঙ্কিত তিনি। তবে ফুল খুব ভাল আসায় এবছর মধু সংগ্রহ এক হাজার টন ছাড়িয়ে যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
তিনি বললেন, ‘এবছর কুয়াশার সাথে খুব শীত পড়েছে। এতে আমার দুই বিঘা জমির সরিষার গুটি খুব ছোট হয়ে আছে। বড় হচেছ না। তারপরও আমি আশাবাদী শেষ পর্যন্ত সরিষার ভাল ফলন হতে পারে।’
একই অবস্থা একই গ্রামের আরেকজন সরিষা চাষী কবীর মোল্লার। তিনিও এবছর দুই বিঘা জমিতে স্থানীয় জাতের মাঘী সরিষার চাষ করেছেন। আবহাওয়া সরিষার উৎপাদন বেশি হওয়ার অনুকূলে না থাকায় প্রচন্ড শীত ও কুয়াশায় সরিষার উৎপাদন নিয়ে শঙ্কিত।
কবীর মোল্লা বলেন, ‘আমি আমার জমিতে উন্নত জাতের বারি-১৪ সরিষা আবাদ করেছি। শীতে একটু সমস্যা হলেও শেষ পর্যন্ত সরিষার উৎপাদন ভাল হবে বলে মনে হচেছ। যদিও ঠান্ডার কারণে কিছুটা শঙ্কিত আছি।
সদর উপজেলার খোয়াজপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা রুবেল হোসেন। তিনি বলেন, আমি তিন বিঘা জমিতে এবছর স্থানীয় ও উন্নত জাতের সরিষার আবাদ করেছি। সরিষা যাই হোক না কেন বাজারে তো ভাল দাম পাই না। বাজারে সিন্ডিকেট আছে। তারাই বাজারে দাম উঠায় আর নামায়। বর্তমানে উৎপাদন খরচ আগের চেয়ে বেশি। তাই বাজারে ভাল দাম না পাইলে লোকসান গুনতে হবে।
সদর উপজেলার আরেক সরিষা চাষী আবুল কালাম খান বলেন, ‘বর্তমানে সরিষা চাষ করে আমরা লাভবান হইতে পারছি না। বাজারে সিন্ডিকেটের কারণে দাম খুব কম পাই। আমাদের এক মণ সরিষা উৎপাদন করতে বর্তমান বাজারে ৩২’শ টাকা থেকে ৩৩’শ টাকা খরচ হয়। কিন্তু সিন্ডিকেটের কারণে হাটে নিয়ে গেলে দাম পাই ৩৫’শ থেকে ৩৬’শ টাকা। তাতে আমাদের তেমন পোষায় না। এই সিন্ডিকেট যদি সরকার ভেঙ্গে দিত, তাহলে আমরা কৃষকরা ন্যায্য দাম পাইতাম।
একই অবস্থা জেলার ডাসার, রাজৈর ও শিবচর উপজেলার অন্যান্য সরিষা চাষীদেরও। তারা বলছেন, সরিষার উৎপাদন খরচ আগের চেয়ে বেড়েছে। বাজারে সরিষার বিক্রির সিন্ডিকেটের কবলে তারা ন্যায্য দাম উঠাতে পারছে না। সিন্ডিকেট ভেঙ্গে সরিষার ন্যায্য মূল্য কৃষক যাতে পেতে পারে সরকারের কাছে সেই ব্যবস্থার দাবী করেন তারা।
মাদারীপুর কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, শীত পড়লেও সরিষার উৎপাদন ভাল হবে বলে তারা আশা প্রকাশ করছেন। সরিষার বাণিজ্যিক চাষাবাদ সম্প্রসারণের জন্য কৃষকদের নানা ধরনের পরামর্শ দিয়ে আসছেন।
এই বিষয়ে মাদারীপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সন্তোষ চন্দ্র চন্দ বলেন, ‘চলতি বছর শীত বেশ পড়েছে। এতে কিছু কিছু সরিষা চাষীরা ফলন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করলেও তেমন একটা ক্ষতি হবে না বলেই মনে করছি। দেশী তেলের ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় সরিষার দামও আগের চেয়ে অনেক ভাল পাচ্ছেন কৃষকরা। তবে বাজারের সিন্ডিকেটের বিষয়ে আমার কাছে কোন তথ্য নেই। বাজার মূল্যের এই বিষয়টি কৃষি বিপণন কর্মকর্তারা দেখেন। তারাই ভাল বলতে পারবেন।
সরিষার বাজারের সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে জেলা কৃষি বিপণন কর্মকর্তা মো. বাবুল হোসেন বলেন, ‘আমার জেলা প্রশাসকের নির্দেশে ইতোমধ্যে মাদারীপুরে যে সমস্ত তেলের মিল রয়েছে। সেসব তেল মিলের মালিকদের নিয়ে মতবিনিময় সভা করেছি। সেখানে সরিষার বাজারে কৃষকদের ন্যায্য দাম দিয়ে সরিষা ক্রয় না করলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানানো হয়েছে।
বাজার নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে মাদারীপুর জেলা প্রশাসক মো.মারুফুর রশিদ খান বলেন, ‘কৃষকদের ন্যায্য দাম পেতে কোন সিন্ডিকেট থাকবে না। যদি কোন অসাধু ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে কৃষকদের ন্যায্যমূল্য না দেয়, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। মাদারীপুরে কৃষকদের কম দাম দিয়ে ঠকানোর কোন সুযোগ নেই।
মাদারীপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাব মতে এ বছর সরিষা আবাদ হয়েছে ১৬ হাজার ৯’শ ৮২ হেক্টর জমিতে। যা থেকে ২২ হাজার ৭৬ মেট্রিক টন সরিষার উৎপাদন হবে বলে আশা প্রকাশ করছে কৃষি অধিদপ্তর।
বাংলাদেশ মৌচাষ কল্যাণ ফাউন্ডেশনের ফরিদপুর অঞ্চলের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার সরদার বলেন, ‘আমাদের ফরিদপুর অঞ্চলের মাটিতে সরিষা ধনিয়া ও কালোজিরার গুনগত মান খুব ভাল হয়। এই জন্য এই অঞ্চলের মধুও অনেক ভাল মানের হয়। আমরা আশা করছি, চলতি মৌসুমে মাদারীপুর জেলায় ২’শ মেট্রিক টন মধু সংগ্রহ করা হবে। আর বৃহত্তর ফরিদপুরের ৫ জেলা মাদারীপুর, শরীয়তপুর, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর ও রাজবাড়ী থেকে ১ হাজার টনের বেশি মধু সংগ্রহ করা হবে।
মাদারীপুরে সিন্ডিকেটের জালে সরিষা চাষীরা ন্যায্য দাম নিয়ে শঙ্কিত
![](https://dainikjanmobhumi.com/wp-content/uploads/2024/02/04-02-2024-5-330x220.jpg)
Leave a comment