জন্মভূমি ডেস্ক : ২০২২ সালে বাংলাদেশিদের জন্য শ্রমবাজার খোলার পর, গেল মে মাসে সর্বোচ্চ সংখ্যক কর্মী মালয়েশিয়া পাড়ি দিয়েছেন।
যদিও নির্ধারিত সময়সীমা ৩১ মে’র মধ্যে যেতে প্রস্তুত আরও প্রায় ১৭,০০০ জনের টিকিট জোগাড় করতে না পারায় তাদেরকে সেদেশে পাঠাতে পারেনি নিয়োগকারী সংস্থাগুলো। এরপরেও নতুন করে শ্রমবাজার খোলার পর মে মাসেই বাংলাদেশ থেকে সর্বোচ্চ সংখ্যক কর্মী গিয়েছেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই দেশটিতে।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুসারে, মে মাসে মোট ৪৭,৮০৯ জন বাংলাদেশি বিদেশি কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে কুয়ালালামপুর পাড়ি দিয়েছেন।
এদিকে, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন (এনএইচআরসি) মালয়েশিয়াগামী শ্রমিকদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে।
অন্যদিকে, মালয়েশিয়াগামী শ্রমিকদের কাছ থেকে নির্ধারিত অঙ্কের চেয়ে বেশি টাকা আদায়ের ইস্যুতে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞদের কাছে নিজের অবস্থান স্পষ্টও করেছে বাংলাদেশ। বলা হয়েছে, অতিরক্ত অর্থ আদায়ের সঙ্গে উভয় দেশের মধ্যস্বত্বভোগীরা জড়িত।
বিএমইটি-এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ মে মাসে মোট ১ লাখ ৩২ হাজার ৬৯১ জন কর্মীকে বিদেশে পাঠিয়েছে— যা ১৯৭৬ সাল থেকে শ্রম অভিবাসনের ইতিহাসে এক মাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যক।
মালয়েশিয়া যেতে প্রস্তুত ওই ১৭ হাজার শ্রমিকও যদি ব্যর্থ না হতেন, তাহলে এই সংখ্যা গত আগস্টের ১.৩৮ লাখকে ছাড়িয়ে একক মাসের হিসাবে বিদেশি কর্মসংস্থানের রেকর্ড গড়তে পারতো। কিন্তু নিয়োগকারী এজেন্সিগুলোর সিন্ডিকেট এই অভিবাসন প্রত্যাশীদের জন্য সময়মতো টিকিটের ব্যবস্থা করতে না পারায় এমনটি হয়নি।
এরইমধ্যে বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য আবারও শ্রমবাজারের দরজা বন্ধ করে দিয়েছে মালয়েশিয়া। ফলে চলতি জুনেই বাংলাদেশিদের জন্য বিদেশি কর্মসংস্থানের সুযোগ হ্রাস পেতে পারে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে শ্রমিক নিয়োগকারীরা সংস্থাগুলো।
এছাড়া বাংলাদেশি শ্রমিকদের আরেক সুপরিচিত গন্তব্য মালদ্বীপও গত মাসে তার শ্রমবাজারের দরজা বন্ধ করে দিয়েছে।
ছয় মাসের স্থগিতাদেশের পর ওমান ভিসা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও, তারা এবার মূলত দক্ষ ও পেশাদার কর্মী নিয়োগ দেবে। অর্থাৎ, স্বল্প-দক্ষ বা অদক্ষ কর্মীদের জন্য এই মুহূর্তে আর তেমন সুখবর নেই; বিশেষ করে যাদের প্রধান গন্তব্য মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সি (বায়রা) সাবেক মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান বলেন, “কোনো বাজারই স্থিতিশীল নয়, তাই আমরা চাইলেই ধরে রাখতে পারব না। এটি মূলত নির্ভর করে গন্তব্য দেশের ওপরে। তাদের কর্মীর চাহিদা থাকলে তারা মার্কেট ওপেন রাখবে।”
তিনি বলেন, “তবে আমাদের জায়গা থেকে চাইতে হবে যেন মার্কেট খোলা থাকে। এখন দেখতে হবে মালয়েশিয়াসহ অন্য মার্কেটগুলো কেন বন্ধ হলো। কারণ নির্ধারণ করে সেগুলো খোলার জন্য চেষ্টা করতে হবে।”
“আর যারা যাচ্ছে, তারা কাজ পাচ্ছে কি-না, একইসঙ্গে তারা যেন স্বল্প খরচে যেতে পারেন বিষয়টি নিশ্চিত করতে সরকার এবং বায়রা সবাইকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে,” যোগ করেন তিনি।
বিএমইটি তথ্যে দেখা যায়, গত মাসে বিদেশি কর্মসংস্থানের সুযোগ এপ্রিলের তুলনায় ৫৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং গত বছরের মে মাসের তুলনায় বেড়েছে ২৯.৬৭ শতাংশ। এছাড়া, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, প্রবাসীরা চলতি বছরের মে মাসে ২.২৫ বিলিয়ন রেমিট্যান্স পাঠিয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের ১.৬৯ বিলিয়ন ডলারের তুলনায় ৩২ শতাংশ বৃদ্ধি।
বিদেশ যাওয়া কর্মীদের সংখ্যা বাড়লেও সে তুলনায় রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধি কমই রয়েছে। সাধারণত ঈদের মতো উৎসবকে ঘিরে রেমিট্যান্স প্রবাহ কিছুটা বাড়ে। সংশ্লিষ্টরা এরজন্য হুন্ডির বাজারকে দায়ী করেছেন। বৈধ চ্যানেলের তুলনায় ডলারপ্রতি ২ থেকে ৩ টাকা বেশি দেওয়ার কারণে সাধারণ প্রবাসীরা মূলত হুন্ডি বাজারের দিকে ঝুঁকছেন বেশি।
বরাবরের মতো মে মাসে সৌদি আরবেই সবচেয়ে বেশি কর্মী নিয়োগ হয়েছে বাংলাদেশ থেকে। প্রাথমিকভাবে নির্মাণ শ্রমিক, পরিচ্ছন্নতাকর্মী এবং গৃহপরিচারকের মতো স্বল্প-দক্ষ কাজেই বেশি লোক নিয়োগ হয়েছে বলে জানান শ্রমিক নিয়োগকারীরা।
সৌদির পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যক কর্মী নিয়োগ দেয় মালয়েশিয়া। এদেশে প্রধানত উৎপাদন, প্ল্যানটেশন, নির্মাণ এবং পরিষেবা খাতে নিয়োগ দেওয়া হয় কর্মীদের। এসব খাতে তাদের ন্যূনতম মাসিক বেতন ৩৫ হাজার টাকা— যা সৌদি আরবের তুলনায় ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা বেশি।
সৌদি আরব এবং মালয়েশিয়ার পরে কাতার, সিঙ্গাপুর, কিরগিজস্তান, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং কুয়েত বাংলাদেশের কর্মীদের শীর্ষ গন্তব্য। এছাড়া সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ক্রোয়েশিয়া, রোমানিয়া, যুক্তরাজ্য, ইতালি এবং দক্ষিণ কোরিয়ার মতো কিছু দেশ বাংলাদেশ থেকে কয়েকশো কর্মী নিয়োগ দিয়েছে।
১৫০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ তদন্তের নির্দেশ জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের ঃ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে মালয়েশিয়াগামী প্রায় ৩০ হাজার বাংলাদেশির কাছ থেকে ১৫০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ অবিলম্বে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন।
সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে মালয়েশিয়াগামী কর্মীদের বঞ্চনার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে কমিশন স্বতঃপ্রণোদিত অভিযোগ (সুয়োমটো) গ্রহণ করে এ নির্দেশ দেয়।
স্বতঃপ্রণোদিত অভিযোগে, ভিসা এবং ক্লিয়ারেন্স থাকা সত্ত্বেও যেসব শ্রমিক সময়মতো টিকিটের ব্যবস্থা না হওয়ায় মালয়েশিয়া যেতে পারেননি, তাদের দুর্দশার জন্য দায়ী সংস্থা এবং ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।
একইসঙ্গে, ভিসা পাওয়া শ্রমিকরা যাতে মালয়েশিয়া যেতে পারেন, তা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছে কমিশন।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিবকে এ বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করে আগামী ১০ জুলাইয়ের মধ্যে কমিশনে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞদের উদ্বেগের বিষয়ে অবস্থান পরিষ্কার করলো বাংলাদেশ ঃ মালয়েশিয়াগামী শ্রমিকদের কাছ থেকে নির্ধারিত অঙ্কের চেয়ে বেশি অর্থ আদায়ের অভিযোগের বিষয়ে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেছে বাংলাদেশ সরকার।
বলা হয়েছে, এ ঘটনার সঙ্গে উভয় দেশের লাইসেন্সবিহীন সাব-এজেন্টরা (মধ্যস্বত্বভোগী) জড়িত। তাদের কারসাজিতেই মাঝেমাঝে বেড়েছে অভিবাসনের খরচ।
জেনেভায় বাংলাদেশের স্থায়ী মিশন গত ২৯ মে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারকে পাঠানো চিঠিতে এ তথ্য জানায়। এর আগে, গত ২৮ মার্চ জাতিসংঘের ৪ বিশেষজ্ঞ এ বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়ে যে চিঠি দিয়েছিল, সেই চিঠির জবাবেই জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারকে এ তথ্য জানায় বাংলাদেশ।
চিঠিতে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিকদের শোষণ ও নির্যাতন রোধে বেশ কয়েকটি পদক্ষেপের রূপরেখাও দেওয়া হয়েছে। ২ জুন মানবাধিকার কমিশনের কার্যালয় এই চিঠি প্রকাশ্যে আনে।