যশোর প্রতিনিধি : যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার জহুরপুর ইউনিয়নের ছোটখুদড়া আব্দুল হাই আলিম মাদ্রাসাটি বর্তমানে একটি সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে।১৯৮৫ সালে চিত্রা নদীর পাড়ে প্রতিষ্ঠিত হয় ছোটখুদড়া আব্দুল হাই আলিম মাদরাসা। মাদ্রাসাটি ১৯৯৫ সালে এমপিভুক্ত হয়। বর্তমানে মাদ্রাসাটিতে পাঠদানসহ ব্যাহত হচ্ছে অবকাঠামোগত সব উন্নয়ন। সর্বশেষ, গত ১৩ মার্চ নিয়মনীতি ছাড়াই গোপনে মাদরাসা পরিচালনা পর্ষদ (ম্যানেজিং কমিটি) গঠন করা হয়েছে। আর এতেই উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার কমিটি গঠনের দাবি জানিয়েছেন ক্ষুব্ধ অভিভাবক ও এলাকাবাসী।
তারা অভিযোগ করেছেন, গত ২ বছর ধরে ‘নুর মোহাম্মদ’ নামের সিন্ডিকেট ড্যামকেয়ার স্টাইলে প্রতিষ্ঠানটি লুটেপুটে খাচ্ছে। এ সিন্ডিকেটের নিয়োগ বাণিজ্য, সাধারণ তহবিল ও শিক্ষকদের টিউশন ফি’র টাকা আত্মসাত,বেতন বন্ধ রাখা, উচ্চতর বেতন স্কেল বাড়াতে ঘুষ, এনটিআরসিএ শিক্ষকদের থেকে চাঁদাবাজি, স্বেচ্ছাচারিতাসহ সীমাহীন অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে আজ ডুবতে বসেছে প্রতিষ্ঠানটি। দেখা দিয়েছে শিক্ষার্থী সংকটসহ নানা সমস্যা। এসব বিষয়ে মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড, শিক্ষা অফিসসহ বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ করেছেন অভিভাবক ও এলাকাবাসী।
জানা যায়, ২০১৬ সাল থেকে তিন মেয়াদে প্রতিষ্ঠানের সভাপতি ছিলেন জহুরপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আকবর আলী বিশ্বাস।নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ২০২০ সালে অধ্যক্ষ এবিএম আশরাফুল ইসলামকে অব্যাহতি প্রদান করা হয়। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হন সহকারী অধ্যাপক এনামুল হক। ২০২২ সালে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে আবুল হোসেন মন্ডলকে মাদরাসার নতুন সভাপতি করেন জহুরপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নুর মোহাম্মদ পাটোয়ারী। প্রাক শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগে কোটি টাকা হাতাতে এ কৌশল করেন তিনি। আবুল মন্ডল নামমাত্র সভাপতি হলেও সবকিছু চলে বিদ্যুৎসাহী সদস্য নুর মোহাম্মদ পাটোয়ারীর ইশারারায়। কমিটিতে তারই একান্ত অনুসারী ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ এনামুল হককে সদস্য সচিব করা হয়। এরপর সহকারী মৌলভী শামিনুর রহমান,শরীরচর্চা শিক্ষক এটিএম শামছুজ্জামান ও ইবতেদায়ী ক্বারী হারুন-অর-রশিদকে নিয়ে গড়ে তোলা হয় ধরাশায়ী ‘নুর মোহাম্মদ’ সিন্ডিকেট।
অভিযোগে বলা হয়েছে, চলতি বছরের ১২ মার্চ ছিলো আবুল হোসেন মন্ডলদের কমিটির শেষ দিন ছিল। এরপর নতুন ম্যানেজিং কমিটি গঠনের লক্ষ্যে তফসিল ঘোষণা করা হয় ঠিকই। কিন্তু সাধারণ সভা, ভোটার তালিকা প্রকাশ, প্রচার-প্রচারণা, মনোনয়নপত্র বিক্রি, যাচাই-বাছাই ও প্রতিক বরাদ্দ কোনোটিই করা হয়নি। এমনকি শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচনসহ ভোটের কার্যক্রম সম্পর্কে কোনো কিছুই অবগত নন শিক্ষক-অভিভাবকেরা। ২০২৩ সালের ৩ আগস্ট পত্রিকায় প্রতিষ্ঠাতা ও দাতা সদস্য চেয়ে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। ১৭ আগস্ট নুর মোহাম্মদ পাটোয়ারী প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে ৬ লাখ টাকা এবং দাতা সদস্য হিসেবে তারই ৩ অনুসারী ২০ হাজার করে ৬০ হাজার টাকা সাধারণ তহবিলে জমা দেন। নির্বাচন কার্যক্রম শেষে সেই টাকা ব্যাংক থেকে তুলে দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে সাধারণ তহবিলে আর ৩৮ হাজার টাকা অবশিষ্ট রয়েছে বলে তথ্য মিলেছে।
গেল ১৩ মার্চ থেকে কার্যকর হয়েছে অবৈধ নতুন ম্যানেজিং কমিটি। যার সভাপতি হলেন, নুর মোহাম্মদ পাটোয়ারী, সদস্য সচিব অধ্যক্ষ এবিএম আশরাফুল ইসলাম, শিক্ষক প্রতিনিধি এনামুল হক, শামিনুর রহমান ও হারুন-অর-রশিদ।
এনটিআরসিএ-এর মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত মাদরাসার সহকারী মৌলভী মজনুর রহমান বলেন,”আমার বেতন চালু করার জন্য ৫০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করে। টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানানোর কারণে ২ মাস বেতন আটকে রাখা হয়।’
একইভাই আরবি প্রভাষক রবিউল ইসলাম ও জাকির হোসেনের কাছে ৩০ ও ২০ হাজার টাকা চাঁদা আদায় করেন, মাদরাসার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ এনামুল হক, সহকারী মৌলভী শামিনুর রহমান, শরীরচর্চা শিক্ষক এটিএম শামছুজ্জামান ও ইবতেদায়ী ক্বারী হারুন-অর-রশিদ। তারা চারজন নুর মোহাম্মদ সিন্ডিকেটের লোক হিসেবে বেশি পরিচিত।
অভিযোগ রয়েছে, প্রতিষ্ঠানের সিনিয়র শিক্ষক ওসমান গণি, প্রভাষক মতিয়ার রহমান, শহিদুল ইসলাম ও সহকারী মৌলভী মাহমুদুর রশিদের কর্মক্ষেত্রে ১০ ও ১৬ বছর অভিজ্ঞতা রয়েছে। তারপরও উচ্চতার বেতন স্কেলের জন্য তাদের কাছ থেকে ১৫ হাজার করে চাঁদা আদায় করা হয়। বাদ যায়নি মাদরাসার চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী জিন্নাত আলীও। তার কাছ থেকে ওই সিন্ডিকেট ৫ হাজার টাকা চাঁদা নেন বলে জানান তিনি।
এবতেদায়ী প্রধান শামছুন্নাহার বলেন, ‘আমাকে নতুন কমিটির শিক্ষক প্রতিনিধি বানানো হয়েছে। অথচ আমি নিজেই সেটি জানিনা। তাই পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছি।’ একইভাবে অভিভাবক সদস্য বানানো হয়েছে ছোটখুদড়া গ্রামের আরমান মোল্যাকে। তিনিও পদত্যাগ করেছেন বলে জানিয়েছেন।
এদিকে, নুর মোহাম্মদ সিন্ডিকেটের ডানহাত হিসেবে পরিচিত সহকারী মৌলভী শামিনুর রহমান বলেন, ‘আমি গভনিংবডির কেউ না। কোনো শিক্ষক বলতে পারবে না আমি ব্যক্তিগতভাবে টাকা নিয়েছি। প্রতিদিন সময়মতোই মাদরাসায় আসি। আমার ক্লাস কখনো নৈশপ্রহরী নিইনি। সব অভিযোগই মিথ্যা।’
প্রাক্তন কমিটির শিক্ষক প্রতিনিধি ও শরীর চর্চা শিক্ষক এটিএম শামছুজ্জামান বলেন,”আমার বিরুদ্ধে আনা শ্লীতহানির সবগুলো অভিযোগ মিথ্যা ও বানোয়াট।’
প্রাক্তন ও বর্তমান কমিটির শিক্ষক প্রতিনিধি, জুনিয়র মৌলভী হারুন-অর-রশিদ বলেন, ‘সাধারণ তহবিল থেকে টাকা তোলার বিষয়টি সভাপতি ও ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ বলতে পারবে।’
স্থানীয় নবনির্বাচিত ইউপি সদস্য জাহিদ হাসান বলেন, ‘নানা অনিয়ম-দুর্নীতিতে ডুবতে বসেছে আজ মাদ্রাসাটি। এভাবে আর চলতে পারেনা। অভিভাবক ও এলাকাবাসীর চাপের মুখে তাদের পক্ষে আমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ডে অভিযোগ করেছি। দ্রুত এই সিন্ডিকেট ভাঙার জোর দাবি জানাচ্ছি।’
ছোটখুদড়া আব্দুল হাই আলিম মাদরাসার অধ্যক্ষ এবিএম আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘দশমাস বিনা বেতনে আমাকে সাসপেন্ড করা হয়। একবছর পর সভাপতি আবুল ভাই, নুর মোহাম্মদ ভাই ও শামিনুর স্যার আমাকে চেয়ারে বসতে দিয়েছেন। কিন্তু এখনো ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ এনামুল স্যারের হাতেই সবকিছু। আমি তো মাটির পুতুল।’
এদিকে, সিন্ডিকেটের বামহাত হিসেবে পরিচিত অভিযুক্ত ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ (সহকারী অধ্যাপক) এনামুল হকের মুঠোফোনে বেশ কয়েকবার কল করলেও নম্বরটি বন্ধ পাওয়ায় তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। এছাড়াও, স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রতিষ্ঠান পরিচালনা পর্ষদের সাবেক সভাপতি আবুল হোসেন মন্ডলের ব্যবহৃত মুঠোফোনে কল করলেও তিনি রিসিভ করেননি। কয়েক মিনিট পরই নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়।
জানতে চাইলে নবগঠিত বিতর্কিত কমিটির সভাপতি নুর মোহাম্মদ পাটোয়ারী বলেন, ‘আমিসহ ৩ জন সভাপতি প্রার্থী ছিলাম। এর মধ্যে আমাকে প্রিসাইডিং কর্মকর্তা সভাপতি ঘোষণা করেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ব্যাংকের মাধ্যমে সাধারণ তহবিলে ৬ লাখ ৬০ হাজার টাকা জমা দিয়েছি আমরা। কিন্তু টাকা তুলে নেওয়ার বিষয়টি জানা নেই। দায়িত্বশীলরাই ভালো বলতে পারবে।’
বাঘারপাড়া উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এ এস এম জিল্লুর রশীদ বলেন, ‘নির্বাচন কার্যক্রম চলাকালীন কেউ কোনো অভিযোগ করেননি। মাদরাসা থেকে সভাপতি প্রার্থী হিসেবে তিনজনের নাম প্রস্তাব পাঠানো হয়। সেটি বোর্ডে পাঠিয়েছিলাম। বোর্ড সভাপতি নির্বাচিত করেছে।’
এ ব্যাপারে যশোর জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. মাহফুজুল হোসেন জানান, ছোটখুদড়া আব্দুল হাই আলিম মাদরাসার বিষয়ে ওপর থেকে একটি তদন্ত আসতে পারে। কিছুতো অনিয়ম-দুর্নীতি হচ্ছেই। তদন্তপূর্বক যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে তিনি আশ্বস্ত করেন ।