খান আঃ জব্বার শিবলী
সরকার বোরো ধান প্রতি কেজি ক্রয় মূল্য নির্ধারণ করেছে ২৭ টাকা। অর্থাৎ প্রতি মণ ধানের ন্যায্য মূল্য ১০৮০ টাকা। এ ধান উৎপাদন করতে একজন দিনমজুরের পারিশ্রমিক ৯০০ টাকা, হাল, সেচ, কীটনাশক, সার প্রয়োগ, ধান কাটা ও মাড়াই সহ অন্যান্য খরচ মিলিয়ে মন প্রতি উৎপাদন খরচ পড়েছে হাজার টাকারও বেশি। তাছাড়া ধান কর্তন করতে গরীব কৃষকের এখনি টাকার প্রয়োজন। অপরদিকে সারা বছর ধান উৎপাদন করতে সার ও কিটনাশকের দোকান থেকে বাকিতে সার-বিষ ক্রয় করার কারনে এপ্রিলের শুরুতে ধান কর্তন করলে এপ্রিলেই ধান বিক্রয় খুবি জরুরি। অন্যথায় কৃষকের ধান উৎপাদন খরচের অর্ধেক মূল্যে পুজিবাদিদের গুদামে মজুদ হবে। পথে বসবে হাজারো কৃষক। কিন্তু এখানে সরকারিভাবে ধান ক্রয় কেন্দ্র থাকার পরও দেরীতে ধান ক্রয় করার কারনে কৃষকগণ তাদের উৎপাদিত বোরো ধান বাধ্য হয়ে বাজারে বিক্রি করছে উৎপাদন খরচের অর্ধেক দামে। যেকারণে রূপসা অঞ্চলে চলতি বোরো মৌসুমে ধানের বাম্পার ফলন হলেও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কয়েক হাজার কৃষক। আরেকটি সমস্যা হলো, দেরিতে ধান সংগ্রহ কর্মসূচি। এপ্রিলে যদি ধান কাটা শুরু হয় তাহলে অন্তত এক মাস আগেই ধান সংগ্রহের যাবতীয় কর্মসূচি সম্পন্ন হওয়া দরকার। এ বছরও সেটা হয়নি। এপ্রিলের শুরুতে ধান কাটা শুরু হলেও ধান সংগ্রহের সিদ্ধান্ত জানানো হয়েছে গত তিন থেকে চার দিন আগে। আরেকটি সমস্যা হলো উপজেলা পর্যায় থেকে সঠিক সময়ে কৃষকদের তালিকা দেওয়া হয় না।
উপজেলায় সরকারিভাবে ধান ক্রয় কেন্দ্র থাকার পরেও নির্ধারিত দামের অর্ধেক দামে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন কৃষকরা। পুজিবাদী অসাধু ধান ব্যবসায়ীরা কোন প্রকার সরকারি অনুমোদন না নিয়ে সরকারি গুদামে ধান বিক্রির আশায় চাষিদের কাছ থেকে ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকা দরে ধান ক্রয় করে মজুদ করে রাখছে। তেমনি কৃষকের কপাল পোড়াতে থেমে নেই মিল মালিকরাও। পরবর্তীতে সরকার যখন মে-জুন মাসে ধান ক্রয় করবে তখন প্রান্তিক চাষিদের ঘরে কোন ধান থাকবেনা। সরকার ধান ক্রয় করবে অসাধু ব্যবসায়ী ও মিল মালিকদের নিকট হতে। এতে কৃষি ঋণ নিয়ে অল্প পুঁজির কৃষকরা চরম আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে ধান চাষের আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে রূপসা উপজেলায় বোরো ধান কিছুটা চিটা হলেও উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি ধান উৎপাদিত হয়েছে। প্রায় ২২ হাজার কৃষক ৮৫১৩ হেক্টর জমিতে উফসী ও হাইব্রিড জাতের বোরো ধানসহ বিভিন্ন সবজি চাষ করেছেন। এরমধ্যে উফসী ৬৫০ হেক্টর জমিতে এবং হাইব্রিড ৫৬৫০ হেক্টর জমিতে ও ২৩৮৩ হেক্টর জমিতে সবজি চাষ করা হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল উফসী, হাইব্রিড মিলিয়ে ৪১০৫১ মেট্রিক টন। ধারনা করা হচ্ছে লক্ষ্যমাত্রা থেকেও ধান উৎপাদন অধিক হবে। কৃষক ইতোমধ্যে বোরো ধান ঘরে তুলতে শুরু করেছে। রূপসাঞ্চলে ধান কাটা শ্রমিক নিয়ে সংকট থাকলেও শেষ পর্যন্ত প্রায় ৮০% ধান কাটা হয়েছে। ধান কাটার জন্য হারভেস্টার সরবরাহ করা হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের সদস্যরা বিশেষ করে ছাত্ররা কৃষকদের ধান কাটার কাজে সহযোগিতা করছে। এগুলো প্রশংসনীয় উদ্যোগ। মিডিয়া ও কর্তৃপক্ষের বিশেষ মনোযোগের কারনে এ সংকট কাটানো গেছে। কিন্তু সমস্যা হলো প্রতিবছর সরকারিভাবে ধান ক্রয়ে অনিয়ম-দুর্নীতি হয়ে থাকে। সরকারি কর্মকর্তাদের নিজের পকেট ভারী করতে স্থানীয় প্রভাবশালী মিলমালিকদের সাথে হাত মিলিয়ে মিল থেকে ধান বুঝিয়া পেয়েছি মর্মে প্রত্যয়ন সংগ্রহ করে পরবর্তীতে ঐ মিলের থেকে সরকারি রেট এবং বাজারের রেট মিলিয়ে লভ্যাংশ উত্তলন করে। ১ মণের বস্তা প্রতি ৩০ টাকা শ্রমিকদের দিতে হয়। তাছাড়া মন প্রতি ৩/৪ কেজি ধান বেশী নাদিলে তার ধান কোনভাবেই ক্রয় করেনা খাদ্য গুদাম কর্তৃপক্ষ। কৃষকদের ধান খাদ্য গুদামে আনার জন্য যাতায়াত বাবদ খরচ সরকার দেওয়ার কথা থাকলেও খাদ্য গুদাম কর্তৃপক্ষ টাকাটি আত্মসাৎ করে নানা ভাবে কৃষকদের হয়রানি করে। এভাবে প্রতি ১০ মণে ১ মণ ধান সরকারি গুদামে ধান বিক্রি করতে হলে বেশী দিতে হয়। তাছাড়া সরকার ধান ক্রয়ের জন্য চাষিদের নিকট বস্তা দেওয়ার নিয়ম করলেও খাদ্য গুদাম কর্তৃপক্ষ নিজস্ব আইন তৈরী করে কৃষকদের বস্তা না দিয়ে নানাভাবে হয়রানি করে আসছে। অপরদিকে প্রভাবশালীদের একটা অংশ ধান ব্যবসায়ীদের নিকট থেকে ধান ক্রয় করে বেশী মুনাফার আশায় সরকারি গুদামে ধান বিক্রি করে এরা প্রকৃত কৃষক নয়-এমন ব্যক্তিদের কারণে প্রকৃত কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এছাড়া, রাজনৈতিক চাপ ও স্বজনপ্রীতিও এর জন্য দায়ী। কৃষকের কাছ থেকে ধান ক্রয়ের সময় তার মান নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। ধানের আর্দ্রতা ১৪ শতাংশের বেশি হলে তা ক্রয় করা হয়। আমাদের দেশে অটোম্যাটিক রাইস মিলের সংখ্যা অনেক বেশি। তাদের কাছে আর্দ্রতার প্রশ্নটা মুখ্য না। কারণ তারা প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে ধান শুকিয়ে নেয়। এটা যদি হয় তাহলে প্রশ্ন জাগে কৃষকদের কেন আর্দ্রতা নিশ্চিতের কথা বলা হয়, এটা তো অটোম্যাটিক রাইস মিলের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক নয়। এক্ষেত্রেও নীতিমালার দরকার আছে।
স্থানীয় আলাইপুর গ্রামের কৃষক লিয়াকত আলী লস্কর, আনন্দনগর গ্রামের কৃষক ইদ্রিস আলী জানান, তারা ব্যাংক থেকে কৃষি ঋণ নিয়ে বোরো ধান চাষ করেছেন। বর্তমান পাইকারি বাজারে ধানের দামের চেয়ে তাদের উৎপাদন খরচ পড়েছে দ্বিগুণ। এতে করে তারা ঋণের বোঝা সহ আর্থিকভাবে জর্জরিত হয়ে পড়েছেন। খুলনা জেলা কৃষকলীগের সভাপতি, ইউপি চেয়ারম্যান অধ্যাপক আশরাফুজ্জামান বাবুল জানান, আমি খুলনা জেলা কৃষকলীগের সভাপতি হিসেবে চাই সরকার প্রান্তিক চাষিদের নিকট থেকে ধান ক্রয় করুক। কিন্তু সেটা আজ স্বপ্নই থেকে গেল। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে ধান চাষিরা আজ ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে।
এ ব্যাপারে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ফরিদুজ্জামান জানান, এ বছর বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। যা বিগত বছরের তুলনায় এ বছর প্রায় ১৪০ হেক্টর বেশি জমিতে বোরো ধানের চাষ করেছে। বিগত আমন মৌসুমে কৃষক ধানের ন্যায্য মূল্য পাওয়ায় এ বছর বোরো ধানের উৎপাদন বৃদ্ধি করেছে। এ মৌসুমেও কৃষক ধানের ন্যায্য মূল্য পাবে বলে আশা করি। উপজেলা নির্বাহি অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) খান মাসুম বিল্লাহ জানান, বর্তমান সরকার কৃষি বন্ধব সরকার। কৃষকের ভাগ্য ফেরাতে হাজার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি প্রদানের মাধ্যমে কৃষকের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। ধান ক্রয়ের বিষয়ে সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা কাজ করে যাচ্ছি। এপ্রিলে ধান ক্রয় করলে কৃষক লাভবান হবে, চাষিদের এ দাবি উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করবো উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মোঃ কামাল উদ্দিন বাদশা জানান, কৃষক যেন তাদের ধানের ন্যায্য মূল্য পান, এজন্য সরকারিভাবে ধান ক্রয়কেন্দ্র স্থাপন করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের আগামীতে আরও সহজ শর্তে কৃষি ঋণ ও ধান চাষে বিভিন্ন উপকরণ সরবরাহ করা হবে।