জন্মভূমি ডেস্ক
২৫শে আগস্ট রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আসার ৫ বছর পূর্ণ হলো। প্রায় ৮ লাখ রোহিঙ্গা ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এর আগেই অবশ্য বাংলাদেশে ৩ লাখ রোহিঙ্গা আগে থেকেই ছিল। ১৯৭৮ এবং ১৯৯১ সালের এক অভিযানের পর ওই রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছিল। সর্বশেষ ২০১৭ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনী রাখাইনের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপর শুরু করে গণহত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ এবং অগ্নিসংযোগ। তাদের বর্বর অত্যাচার নির্যাতনের মুখে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে ৩৪টি আশ্রয় শিবিরে প্রায় ৮ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নেয়। গত ৫ বছরে তাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে আরও দেড় লাখের উপরে।
শুরু থেকে বাংলাদেশ সরকার এবং ‘ইউএনএইচসিআর’-এর তত্ত¡াবধানে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এসব রোহিঙ্গাদের খাদ্য চিকিৎসাসহ বিভিন্ন সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশন ৩৪টি শরণার্থী শিবিরে প্রশাসনিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন দফায় প্রায় এক মিলিয়নেরও বেশি রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের পর বাংলাদেশ সরকার প্রথমে মিয়ানমারের সাথে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু, ক‚টনৈতিক নানা কারণে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু করা যায়নি আজও।
রোহিঙ্গারা যখন প্রথম বাংলাদেশে এসেছিল তখন তাদের উপর নির্যাতন নিয়ে আন্তর্জাতিক স¤প্রদায় ব্যাপক উদ্বেগ দেখিয়েছিল। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাতে ভাটা পড়েছে। বাংলাদেশের মানুষ প্রথমে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার পক্ষে থাকলেও সেই প্রতিক্রিয়ায় পরিবর্তন এসেছে। সেই সহানুভ‚তি আর মানুষের মধ্যে কাজ করছে না। রোহিঙ্গাদের কারণে সংকট বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষও অধৈর্য্য হয়ে পড়ছে। বর্তমানে স্বাভাবিক এবং নিরাপদ প্রত্যাবাসনের কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। বিভিন্ন কারণে এই প্রক্রিয়া থেমে আছে। পাশাপাশি কক্সবাজারের ঘিঞ্জি ক্যম্পগুলোতে সহিংসতা লেগেই আছে। স¤প্রতি প্রথম সাড়ির এক রোহিঙ্গা নেতাকে হত্যার পর বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ বেড়েছে।
হায়দার আলী নামের একজন বললেন, গত ৫ বছরে আমরা দিন দিন পুলিশের চেকপোস্ট বাড়তে দেখছি, চারদিকে আরও বেড়া নির্মাণ করা হচ্ছে। তার জন্ম হয়েছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পেই। ১৯৯১ সালে তার পরিবার বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিল। তিনি জানালেন, এখন ক্যাম্পের মধ্যে বিক্ষোভ নিষিদ্ধ, কিন্তু গ্যাং-এর সংখ্যা বাড়ছে। গত দুই বছরে বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। তাদের মধ্যে একজন হচ্ছেন মোহাম্মদ মুহিবুল্লাহ। তিনি রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার নিয়ে সোচ্চার ছিলেন। ২০২১ সালের ২৯শে সেপ্টেম্বর তাকে অজ্ঞাত বন্দুকধারীরা গুলি করে হত্যা করে।
‘বাংলাদেশ সেন্টার ফর টেরোরিজম রিসার্চ’-এর প্রধান শাফকাত মুনির জানিয়েছেন, ক্যাম্পের মধ্যে সহিংসতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অবস্থা নেতিবাচক দিকে যাচ্ছে। আমাদেরকে বড় পর্যায়ে ক্যাম্পের নিরাপত্তা পর্যালোচনা করে দেখতে হবে। সেখানে কী ধরণের দল, সংস্থা কিংবা ব্যক্তিরা অপরাধ করছে তা জানতে হবে। ক্যাম্পের মধ্যেই বিরোধ নিষ্পতিতে কিছু পরিকাঠামো তৈরি করতে হবে আমাদের। এমন একটি নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করতে হবে যেখানে বাইরের উপাদান সেখানে অনুপ্রবেশ করতে না পারে।
জানে আলম জানিয়েছেন যে, তিনি কাজ করতে চান। কিন্তু তার দিন কাটে নামাজ পড়ে এবং অলস পড়ে থেকে। তার স্বাস্থ্যসেবা, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা এবং সমাবেশের সুযোগ নেই। তার সেখানে কার্যত কিছুই করার নেই। সেখানে থাকা সবারই একই অবস্থা। তিনি বলেন, আমি এখানে কিছু ছোট শিশুদের পড়াশুনা শেখাই। তাদের আমি অংক, বার্মিজ এবং ইংরেজি শেখাই। আলম নিজে ক্লাস টেন পর্যন্ত পড়াশুনা করেছে। এর আগে সে ডিআরসি নামের একটি এনজিওতে কাজ করতো। কিন্তু এনজিওটি চলে গেছে। সে ব্রাকে কাজ করার আবেদনও জানিয়েছে, তবে এখনও কোনো সাড়া পায়নি। আলম আরও বলেন, ক্যাম্পের জীবন সহজ নয়। বাইরে থেকে আমার পরিস্থিতি বুঝা যাবে না।
বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের ঢল নামার পর জাতিসংঘের প্রায় এক বছর সময় লেগেছে মিয়ানমারের সামরিক পদক্ষেপকে গণহত্যা বলে স্বীকৃতি দিতে। আন্তর্জাতিক স¤প্রদায় প্রথম থেকেই রোহিঙ্গাদের পক্ষে সোচ্চার ছিল। তবে সবথেকে বড় পদক্ষেপটি নিয়েছে গাম্বিয়া। ৫৭টি ইসলামিক দেশের সংগঠন ওআইসির সমর্থন নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা করে গাম্বিয়া। দেশটি অভিযোগ করে, মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে। ২০২০ সালে এক রায়ে মিয়ানমারকে রোহিঙ্গা সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের কথা বলা হয়।
যদিও জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ তেমন কিছু করতে পারেনি। তাদের আরও অনেক কিছু করার ছিল। এ নিয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, চীন এবং রাশিয়ার ভোটের কারণে নিরাপত্তা পরিষদে যে নিষ্ক্রিয়তা সৃষ্টি হয়েছে সেটি শেষ হওয়া দরকার। মিয়ানমারের বিরুদ্ধে যত দ্রæত সম্ভব অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা জারি করতে হবে। দেশটির জান্তা সরকার এবং তাদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোকেও নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনতে হবে।