শেখ মাহতাব হোসেন, ডুমুরিয়া : সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য অফিসার আনিছুর রহমান এর বিরুদ্ধে পাহাড়সম দূর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। জানা গেছে, সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য অফিসার আনিছুর রহমান মন্ত্রীসভার বেঁধে দেওয়া পূর্ব নির্ধারিত সময়সুচী অনুযায়ী তিনি অফিস করেন না। এছাড়া তার অধীনস্থ উপজেলা মৎস্য অফিসার ও কর্মচারীরাও সময় মতন অফিস করেন না।
বিশেষ করে কালিগঞ্জ, শ্যামনগর, তালা, কলারোয়া, আশাশুনি উপজেলার মৎস্য কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। সেকারণে অফিসে সেবা নিতে এসে কাংখিত সেবা পাচ্ছেনা চাষীরা।
প্রত্যন্ত এলাকা থেকে সেবা নিতে আসা চাষীরা সঠিক সময় পরামর্শ না পেয়ে আর্থিকভাবে প্রায়শই ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে যা বলার অপেক্ষা রাখেনা। সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য অফিসার আনিছুর রহমান কে ম্যানেজ করার মাধ্যমে তার অধিনস্থ বিভিন্ন উপজেলা পর্যায়ে কর্মরত কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা ঠিক মতো অফিস না করেও বেতন ভাতা উত্তোলন সুবিধা ভোগ করছে।
মৎস্য অফিস কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা ঠিকভাবে অফিস না করার কারণে একদিকে যেমন যুগোপযোগী সেবা এবং পরামর্শ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে চাষীরা অন্যদিকে সরকারি ভাবে প্রান্তিক চাষীদের জন্য নানামুখী কর্মসুচী গ্রহন করলেও সেসব সুযোগ সুবিধা থেকে পিছিয়ে পড়ছে প্রান্তিক চাষীরা। ফলশ্রুতিতে দেশের কল্যাণে ও মৎস্য খাতে চাষীদের টেকসই উন্নয়নে সরকারি মহৎ চেষ্টাকে অনেকটা ব্যহত করছে।
এসব নানা অপকর্ম আর দূর্নীতির সাথে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে জড়িত মৎস্য কর্মকর্তা আনিছুর রহমান। বলা চলে তার অবহেলা আর অবজ্ঞার কারণে নিয়মিত অফিস না করেও পার পাচ্ছে উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা থেকে শুরু করে কর্মচারীরা। এদিকে সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আনিছুর রহমান এর অপকর্মের কারনে বদলির আদেশ ঠেকাতে উপর মহলে দৌড়ঝাপ শুরু হয়েছে। প্রসঙ্গত, সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য অফিসার আনিছুর রহমান এর বিরুদ্ধে ঘুষ বানিজ্য, নারী কেলেংকারী সহ নানা অনিয়ম, দূর্নীতি সহ বিভিন্ন অপকর্মের অভিযোগ এনে গত ইং ২০-০৪-২৪ তারিখ “বাংলাদেশ মৎস্য অধিদপ্তর” মহাপরিচালক বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন ঠিকাদার মোঃ শহিদুল ইসলাম।
অভিযোগ সুত্রে প্রকাশ, মৎস্য অধিদপ্তরে কয়েক বছর ঠিকাদারি কাজ সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করে আসছেন শহিদুল ইসলাম। মাঠ পর্যায়ে তিনি কাজ করার সুবাদে বিভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি ও অফিসারদের সাথে সম্পর্ক বজায় রেখে কাজ বাস্তবায়ন করেন। শহিদুল ইসলাম অভিযোগ তুলে বলেন, সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আনিছুর রহমান তার কর্ফমস্থলে দায়িত্বভার গ্রহণ করার পর থেকে তিনি সময় মতন অফিসে যান না। একইসাথে সাতক্ষীরা জেলার আওতাধীন সকল উপজেলায় তিনি সঠিকভাবে তদারকি করেন না।
জেলা মৎস্য অফিসার আনিছুর রহমান নিয়মিত অফিস না করায় তিনি যেদিন অফিসে আসেন সেদিন তিনি অফিসের কাজ বাদ দিয়ে “চিংড়ি চাষ প্রদর্শনী খামার” এল্লারচর গিয়ে বন্ধু-বান্ধব নিয়ে আড্ডাবাজি করেন। নিজ কর্মস্থল অর্থাৎ সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য দপ্তরে সঠিক ভাবে সংস্কার কাজ না করিয়ে সরবরাহকারী বা কোটেশন প্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের নিকট থেকে অর্থ আত্মসাৎ করে যেনতেন ভাবে দায়সারা কাজ করে সংস্কার কাজ শেষ করেন। এ ছাড়া সাতক্ষীরা জেলার বিভিন্ন উপজেলার কর্মরত মৎস্য অফিসার সহ অন্যান্য কর্মকর্তা ও কর্মচারী গণের মাধ্যমে মাছ চাষী ও খামারীদের নিকট থেকে বিভিন্ন সময় চাঁদা উত্তোলন করেন।
মৎস্য অফিসার আনিছুর রহমান এর দূর্নীতি আর অপকর্ম এতোটাই সীমাহীন যে “সাসটেইনেবল কোস্টাল এন্ড মেরিন ফিসারিজ প্রজেক্ট” এর আওতায় প্রতিটি উপজেলায় খাল খনন কাজ করা হয়। আর এসব খাল খননের তদারকি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তিনি প্রতিটি খালের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নিকট থেকে খাল প্রতি দেড় লক্ষ থেকে শুরু করে দুই লক্ষ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দাবি করেন। ঘুষ গ্রহণের মাধ্যমে সঠিক ভাবে খাল খননের তদারকি না করে তিনি টাকা আত্মসাৎ করেন। শুধু তাই নয়? রীতিমতো তিনি খাল খননকারী প্রতিষ্ঠানের নিকট থেকে মোটা অংকের চাঁদা দাবি করেন। সে কারণে খাল খনন কাজে
ব্যাপক অনিয়ম, দূর্নীতি সংগঠিত হয়।
জেলা মৎস্য অফিসার আনিছুর রহমান এর দূর্নীতির কারণে টেকসই খাল খনন হয়নি তার দৃষ্টান্ত
উদাহরণ কলারোয়া উপজেলার একড়া, নারায়ণপুর ও যুগিখালি ক্লাস্টার। আনিছুর রহমান তার উর্ধতন কর্মকর্তাদের নাম ভাঙ্গিয়ে চাকুরী দেওয়ার
প্রলোভন দেখিয়ে চাকুরী প্রত্যাশিদের নিকট থেকে মোটা অংকের টাকা নিয়ে আত্মসাৎ করেছেন। সাতক্ষীরা জেলা ব্যাপি তার চাকরি বানিজ্যের একটি সক্রিয় সিন্ডিকেট চক্র আছে। জেলা মৎস্য অফিসার আনিছুর রহমান ইতিমধ্যে তার বিধিবহির্ভূত ভাবে অর্জিত কোটি কোটি টাকা দিয়ে নামে বেনামে অঢেল সম্পত্তি ক্রয় করে গড়েছেন বিলাসবহুল বাড়ি।
সাতক্ষীরা জেলার আওতাধীন যত মহিলা কর্মকর্তা, কর্মচারী আছে, সে তাদের মোবাইল হোয়াটস অ্যাপ, ইমো, ম্যাসেঞ্জারে বিভিন্ন ধরনের আপত্তিকর কথাবার্তা বলে ম্যাসেজ প্রদান করেন এবং অশ্লীল অডিও-ভিডিও প্রেরণ করে থাকেন যা একজন সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে খুবই লজ্জাজনক এবং গর্হিত কাজ। এ ছাড়া তিনি কাজের তদারকির কথা বলে শ্যামনগর উপজেলায় বেশি যাতায়াত ছিল জেলা মমৎস্য অফিসার আনিছুর রহমানের। মূলত তিনি মাঠ তদারকিতে যাওয়ার কথা বলে বাস্তবে শ্যামনগর উপজেলায় তিনি বিভিন্ন রিসোর্টে নারী নিয়ে আমোদ-প্রমোদ ও দৈহিক সম্পর্ক স্থাপনে ব্যস্ত সময় পার করেন।
এসব অপকর্মের পাশাপাশি তিনি লাল পানি অর্থাৎ মদ্যপানে অভ্যস্ত ছিলেন। তার পূর্বের কর্মস্থল যশোর জেলায় থাকাকালীন তিনি শার্শা উপজেলায় গিয়ে মদ ও নারী নিয়ে থাকতেন। তাছাড়া তিনি তৎকালীন সময় যশোর জেলা মৎস্য অফিসার হিসেবে কর্মরত থাকা অবস্থায় “ন্যাশনাল এগ্রিকালচারাল টেকনোলজি প্রোগ্রাম ফেজ-২ প্রজেক্ট (এনএটিপি-২) প্রকল্প” পরিচালক এস,এম, মনিরুজ্জামান এর সাথে সু-সম্পর্ক স্থাপন করেন। এ সময় তার নাম ভাঙ্গিয়ে মাঠ পর্যায়ে বিভিন্ন দপ্তর থেকে বিভিন্ন সময় চাঁদা উত্তোলন করতেন। এনএটিপি-২ প্রকল্পের এগ্রিকালচারাল ইনোভেশন ফান্ড (এআইএফ-২,৩) এর আওতায় অনুদান দেওয়ার কথা বলে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ও সিআইজি সদস্যদের নিকট থেকে টাকা দাবি করতেন।
ক্ষুদ্র উদোক্তা বা সিআইজি সদস্যরা টাকা দিলে তাদের উপ-প্রকল্পের প্রস্তাব ঢাকায় প্রেরণ করতেন এবং এনএটিপি-২ প্রকল্প পরিচালক তার বন্ধুর নিকট হতে পাশ করিয়ে নিতেন। প্রকল্প পাশ করানোর পর কেনা কাটাতেও তিনি মধ্যস্ততাকারী বা মিডিয়া হিসেবে কাজ করে একটি নির্দিষ্ট পরিমান টাকা সরবরাহকারীর নিকট থেকে হাতিয়ে নিতেন। মাঠ পর্যায়ে প্রদর্শনী বাস্তবায়নে তার ছিল ব্যাপক অনিয়ম। প্রতিটি প্রদর্শনীর জন্য তিনি ৩ হাজার থেকে শুরু করে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত দাবি করতেন।
যশোর জেলা মৎস্য অফিসার থাকাকালীন এনএটিপি-২ প্রকল্পের সম্প্রসারণ কর্মকর্তা জিনিয়া করিম তৃপ্তি, মুনিয়া খাতুন ও প্রিয়াংকা ফেরদৌস এবং ক্ষেত্র সহকারী জান্নাতুল ফেরদৌসকে কু-প্রস্তাব দিতেন। এ ছাড়া তিনি তাদেরকে রিসোর্টে রাত্রিযাপন করার প্রস্তাবও দিয়েছেন বলে লোক মুখে ব্যপক গুঞ্জন রয়েছে। সম্প্রসারণ কর্মকর্তা লিপি পাল কে নিয়ে তিনি বেশ কয়েক বার অর্থাৎ মাঝে মধ্যে মৎস্য অধিদপ্তরের কোটচাঁদপুর খামার ও বাঁওড়ে যান এবং তার সাথে অন্তরঙ্গভাবে মেলামেশা, নৌকা ভ্রমন ও আমোদ-প্রমোদ করেন। তিনি যশোরে থাকাকালীন সময় নিয়মিত মদ্যপান এবং পর নারীতে আসক্ত হওয়ায় নিজ স্ত্রীর সাথে প্রায়শই তার ঝগড়া বিবাদ চলে আসছিলো।
এ বিষয় সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোঃ আনিছুর রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অপকর্ম, উৎকোচ গ্রহণ, মদ্যপান সহ নারী কেলেঙ্কারি অভিযোগের ব্যাপারে মুঠোফোনে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ সম্পুর্ন মিথ্যা। এ বিষয় খুলনা বিভাগ এর মৎস্য অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মোঃ জাহাঙ্গীর আলম মুঠোফোনে আলাপকালে বলেন, সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য অফিসার আনিছুর রহমান এর বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ পায়নি। অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যাবস্থা নেওয়া হবে। এ বিষয় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এর সচিব সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দার মুঠোফোনে আলাপকালে বলেন, অভিযোগের বিষয়টি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ বিষয় বাংলাদেশ মৎস্য অধিদপ্তর এর মহাপরিচালক সৈয়দ মোঃ আলমগীর মুঠোফোনে আলাপকালে বলেন, বিষয়টি তদন্তধীন আছে।