বিশেষ প্রতিবেদক : বাংলাদেশের নৌযানগুলোর গভীর সমুদ্রাঞ্চল থেকে মৎস্য আহরণ সক্ষমতা না থাকায় এবং এ নিয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে উদ্যোগের সমন্বয়হীনতায় বিশাল সমুদ্র এলাকা থেকে পেলাজিক মৎস্য সম্পদ আহরণ ব্যাহত হচ্ছে। এমনকি স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরোলেও ১০০ মিটার গভীরতার বাইরের সমুদ্র সম্পদ সম্পর্কে এখনো কোনো জরিপ পরিচালনা করতে পারেনি বাংলাদেশ।
৬১ কোটি ছয় লাখ টাকা ব্যয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় গভীর সমুদ্রে টুনা ও সমজাতীয় পেলাজিক মাছ আহরণের জন্য পাইলট প্রকল্প নেয় ২০২০ সালের জুলাইতে। গভীর সমুদ্রে টুনা মাছ ধরতে তিনটি লং লাইনার প্রকৃতির ফিশিং ভ্যাসেল সংগ্রহের কথা থাকলেও এখনো আলোর মুখ দেখেনি সেই উদ্যোগ। অভিযোগ রয়েছে, এই সুযোগে দুটি প্রতিবেশী দেশের (ভারত ও শ্রীলঙ্কার) জেলেরা প্রতিনিয়ত বঙ্গোপসাগরের গভীর জলসীমায় অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ করে বিপুল পরিমাণ মাছ লুটে নিচ্ছে।
সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ প্রজেক্ট এর সাবেক পরিচালক এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটির অতিথি শিক্ষক গবেষক হাসান আহম্মেদ চৌধুরী বলেন, আমাদের জেলেরা সমুদ্রের ৬০ মিটারের বেশি গভীরে গিয়ে মাছ ধরতে পারেন না। বেসরকারি বাণিজ্যিক জাহাজগুলোর সক্ষমতা থাকার পরও ১০০ মিটারের বেশি গভীরতায় ফিশিং করে না। ফলে গভীর সাগরে টুনাসহ সমগোত্রীয় মাছ শিকারে বাংলাদেশের কোনো আশাব্যঞ্জক অগ্রগতি বা সফলতা নেই। অথচ আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ শুধু টুনা মাছ রপ্তানি করে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার আয় করছে।
২০১৮ সালে ইন্ডিয়ান ওশান টুনা কমিশনের (আইওটিসি) সদস্যপদ পায় বাংলাদেশ। যার মাধ্যমে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক জলসীমায় মাছ ধরার অধিকার পেয়েছে। সদস্য দেশ হিসেবে সংস্থাটিকে প্রতিবছর ৭০ হাজার মার্কিন ডলার (৭৭ লাখ টাকা) পরিশোধ করতে হয় বাংলাদেশকে। কিন্তু সক্ষমতা না থাকায় এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক জলসীমায় মাছ শিকার করতে পারেনি বাংলাদেশ।
গভীর সমুদ্রে টুনা মাছ ধরতে তিনটি লং লাইনার প্রকৃতির ফিশিং ভ্যাসেল সংগ্রহের কথা থাকলেও এখনো আলোর মুখ দেখেনি সেই উদ্যোগ। অভিযোগ রয়েছে, এই সুযোগে দুটি প্রতিবেশী দেশের (ভারত ও শ্রীলঙ্কার) জেলেরা প্রতিনিয়ত বঙ্গোপসাগরের গভীর জলসীমায় অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ করে বিপুল পরিমাণ মাছ লুটে নিচ্ছে
সামুদ্রিক মৎস্য দপ্তর, চট্টগ্রামের সাবেক পরিচালক মো. শরিফ উদ্দীন বলেন, রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারিভাবে টুনা ও সমগোত্রীয় মাছ শিকারের জন্য ১৭টি প্রতিষ্ঠানকে জাহাজ আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেসব প্রতিষ্ঠান এ খাতে বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছে না।
তবে ‘সরকারের দ্বৈত নীতির কারণে গভীর সাগরে টুনা বা পেলাজিক মাছ শিকার সম্ভব হচ্ছে না’- এমনটিই মনে করেন বাংলাদেশ মেরিন ফিশারিজ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এসকে আবিদ হুসাইন।
তিনি বলেন, নীতিমালা অনুযায়ী ২০০ মিটার গভীরতার পরে সাগরে মাছ ধরতে যে জাহাজ প্রয়োজন তা আমদানির জন্য খরচ হবে শতকোটি টাকা। অথচ এখন পর্যন্ত সরকার সেখানে একটি জরিপ পরিচালনাও করতে পারেনি। তাহলে ব্যবসায়ীরা কী ভরসায় জাহাজ আমদানিতে এত বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করবে?এসকে আবিদ হুসাইনের ভাষ্য, সরকার ব্যবসায়ীদের টুনা শিকারের জন্য ৫৫ মিটারের বেশি দৈর্ঘ্যের জাহাজ আমদানি করতে বলছে। অথচ এ খাতে সরকারি প্রকল্পের জন্য তিনটি জাহাজ কেনা হচ্ছে মাত্র ২৫ মিটার দৈর্ঘ্যের। এ বৈষম্য কেন? আমাদেরও যদি ওই মানের জাহাজ দিয়ে টুনা শিকারের অনুমতি দেওয়া হতো তবে মৎস্য আহরণে দেশ অনেক এগিয়ে যেতো। এছাড়া টুনার মত পেলাজিক মাছ আহরণের জন্য পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ উদ্যোগ নেওয়া হলে তা বেশি সময়োপযোগী হবে বলে মনে করি।
তবে আশার কথা শোনাচ্ছেন মৎস্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক আনিছুর রহমান তালুকদার। তিনি জানান, দাপ্তরিক বিভিন্ন জটিলতায় লং লাইনার কেনার কাজটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আগামী মার্চ মাস নাগাদ গভীর সাগরে টুনা মাছের জরিপ কাজ পরিচালনার জন্য দুটি লং লাইনার কেনার কাজ সম্পন্ন হবে।