কয়রা প্রতিনিধি : সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে সুন্দরবনসংলগ্ন বঙ্গপোসাগর এবং সুন্দরবনের বিভিন্ন নদী ও খালে অবাধে চলছে পারশে মাছের পোনা নিধন। বনের অভয়ারণ্য এলাকাসহ বিভিন্ন খালে ও নদীতে নেট জাল দিয়ে চলছে পোনা আহরণ।
অল্প পরিশ্রমে বেশি রোজগারের আশায় দীর্ঘদিন অসাধু জেলে ও মহাজন পারশে পোনা নিধন অনেকটা প্রকাশ্যে করলেও সরকারি দপ্তরগুলো নিশ্চুপ রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সুন্দরবনের বিভিন্ন নদী খাল থেকে পোনা আহরণ করে বনের ভেতরের বিভিন্ন রুট দিয়ে নিয়ে পাইকগাছায় বিক্রি করা হচ্ছে।
নিধনকারীরা প্রথমে সাদা মাছ পরিবহনের জন্য ট্রলারের অনুমতি নেয়। এরপর সাদা মাছ আহরণের বদলে তারা সুন্দরবনের আলোর কোল, দুবলার চর, বঙ্গবন্ধুর চর, বাটলুরচর, নেরালী, কালার মাথা, মজ্জতের গোড়া, মানিকখালী, নীলবাড়ী, নারীকেলবাড়িয়া, টিয়ের চর, পশুর, আগুন জ্বলা, মজ্জত নদী থেকে বিপুল পরিমাণ পারশে মাছের নিষিদ্ধ পোনা আহরণ করে। এ ক্ষেত্রে মনো ফিলামেন্ট নেট ব্যবহার করায় পারশে পোনাসহ নিধন হচ্ছে বাগদা, গলদা ও বিভিন্ন প্রজাতি মাছের পোনা। পোনা ধরার জন্য ব্যবহৃত জালের কারণে নষ্ট হয় লাখ লাখ প্রজাতির জলজ প্রাণী।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (পাইকগাছা নোনা পানি গবেষণা কেন্দ্র) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, একটি পারশে পোনা আহরণের বিপরীতে কমপক্ষে ১১৯ চিংড়ি, ৩১২ প্রাণিকণা ও ৩১টি অন্য প্রজাতির মাছের পোনা ধ্বংস হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক জেলে জানান, দ্রুতগামী ট্রলারের মাধ্যমে প্রতিটি দলে ৮/১০ জন জেলে ২০০-৩০০ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ৪০-৫০ মিটার প্রস্থ নেট জালের মাধ্যমে মাছের পোনা আহরণ করে থাকে। জাল একবার টানলে, ভাগ্য ভালো থাকলে দুই থেকে তিন মণ পারশে পোনা পান। এভাবে দুদিন পরপর প্রতিটি ট্রলারে ৭-৮ মণ পারশে পোনা লোকালয়ে নিয়ে মাছের ঘের পর্যন্ত যেতে অর্ধেকের বেশি মারা যায়।
ঊর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তিরা সুন্দরবনে অভিযানে আসলে অসাধু বনকর্মচারীরা আগেই জেলেদের জানিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ জেলেরা বনের মধ্যে পালিয়ে থেকে অভিযান শেষ হলে আবারও পোনা ধরতে থাকে। বনের এসব এলাকা থেকে পোনা আহরণ করে ট্রলারের মাধ্যমে আসে শিবসা নদীতে। সেখান থেকে বন বিভাগের নলিয়ান কার্যালয়ের সামনে দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় পাইকগাছায় লিটনের মোকামে।
পাইকগাছা সেতুর নিচে দক্ষিণ পাশে প্রকাশ্যে বেচাকেনা হয় এসব পোনা। বর্তমানে বাজারে পারশে পোনা প্রতিকেজি ১৫ থেকে ২৫শ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। শিবসা নদী দিয়ে পোনা আসতে জেলেরা ম্যানেজ করে নলিয়ান স্টেশন, হড্ডা ক্যাম্প ও আদাচাকি ক্যাম্প।
অভিযোগ রয়েছে, এসব স্টেশন ও ক্যাম্প পার হতে গেলে বন বিভাগের কতিপয় কিছু অসাধু কর্মকর্তাকে দিতে হয় মোটা অংকের টাকা। এরপর তাদের সহযোগিতায় পার হয় এসব ট্রলার।
নলিয়ান স্টেশন কর্মকর্তা তানজিরুল ইসলাম বলেন, আমার এলাকার সার্বক্ষণিক নজরদারি ও টহল জোরদার আছে। আমার এলাকায় পারশে ধরার কোনো সুযোগ নেই।
সংশ্লিষ্টরা জানান, গলদা, বাগদা পোনা শিকারের জন্য ব্যবহৃত ঘন ফাঁসের বেহেস্তি জাল ব্যবহার করে পারশে পোনা ধরতে গিয়ে অন্য প্রজাতির কোটি কোটি পোনা ধ্বংস করছেন জেলেরা। এতে সুন্দরবন এলাকায় আশঙ্কাজনকহারে মাছের উৎপাদন কমে যাচ্ছে। অথচ ২০০০ সালে মৎস্য ও পশুসম্পদ মন্ত্রণালয় এক প্রজ্ঞাপনে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলসহ যে কোনো প্রাকৃতিক উৎস থেকে সব ধরনের পোনা আহরণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু সরকারি এ নিষেধাজ্ঞা উপকূলীয় অঞ্চলে কখনো কার্যকর হয়নি।
তবে এসব অভিযোগ অস্বিকার করে সুন্দরবন পশ্চিম রেঞ্জের খুলনা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ড. আবু নাসের মোহাম্মদ মহসীন হোসেন বলেন, আমি যোগদানের পর এসব ট্রলার একেবারেই বন্ধ করে দিয়েছি। সুন্দরবন অভ্যন্তরে কোথাও পারশে পোনা ধরতে দেওয়া হয় না। সাগর থেকে ধরে নিয়ে আসতে পারে জেলেরা। পশ্চিম সুন্দরবনে ট্রলার প্রবেশেরও অনুমতি নেই।
শিবসা নদীর রুট ব্যবহারের বিষয়ে তিনি বলেন, আমি শিবসা নদীসংলগ্ন সবগুলো স্টেশন ক্যাম্পে এখনই নোটিশ করছি। যাতে এ ধরনের ট্রলার দেখলেই তা জব্দ করা হয়।