সি আর দত্ত শুধু একটি নামই নয়; এর সাথে জড়িয়ে আছে গভীর ভালোবাসা, বিন¤্র শ্রদ্ধা আর উৎসাহের অকল্পনীয় অনুপ্রেরণা। আসল নাম চিত্ত রঞ্জন দত্ত। ছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একজন সেক্টর কমান্ডার। ৪ নম্বর সেক্টরের দায়িত্ব পালন করেছেন কৃতিত্বের সাথে। মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি বীরউত্তম খেতাবে ভ‚ষিত হয়েছেন। শুরু থেকে সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের সাথে যুক্ত ছিলেন। এদেশের সংখ্যা লঘুদের অধিকার রক্ষায় তিনি নিরলস কাজ করেছেন। ছিলেন সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল। বাংলাদেশ সীমান্ত রক্ষাবাহিনী তাঁর হাত দিয়েই তৈরী হয়েছে। তাঁর ঠাকুর দাদা হবিগঞ্জের জমিদার ছিলেন। এখনো দত্তবাড়ি, দত্ত পুকুর এবং ঠাকুর দাদার জমিতে প্রতিষ্ঠিত স্কুলটি রয়েছে হবিগঞ্জে।
বাবার বদলির চাকরির সূত্রে সি আর দত্তের জন্ম ১৯২৭ সালের ১ জানুয়ারি আসামের শিলংয়ে। পাঁচ ভাই দুই বোনের ভাইদের মধ্যে তিনি তৃতীয়। বোনেরা বড়। ছোট বেলার ডাকনাম ছিলো রাখাল। পৈতৃক বাড়ি হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার মিরাশি গ্রামে। বাবা উপেন্দ্র চন্দ্র দত্ত ছিলেন পুলিশ অফিসার, মা লাবণ্য প্রভা দত্ত। শিলংয়ের লাবান গভর্নমেন্ট হাইস্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলেন। পরবর্তীকালে বাবা চাকরি থেকে অবসর নিয়ে হবিগঞ্জে এসে স্থায়ী বসবাস শুরু করেন। হবিগঞ্জ গভর্নমেন্ট হাই স্কুল থেকে ১৯৪৪ সালে তিনি মাধ্যমিক পাশ করেন। পরবর্তীতে তিনি কলকাতার আশুতোষ কলেজে বিজ্ঞান শাখায় ভর্তি হয়ে ছাত্রাবাসে থাকা শুরু করেন। তবে সেখানে খুব বেশি দিন থাকেননি। বাবা ভেবেছিলেন, সেখানে থাকলে ছেলের লেখাপাড়া হবে না। একবার বাবা টাকা পাঠালেন, সঙ্গে হোস্টেল সুপারকে তাঁর ভর্তি বাতিলের জন্য চিঠিও দিলেন। হোস্টেল সুপার তাঁকে ডেকে বললেন, ‘তোমার বাবা চিঠি দিয়েছেন, তুমি আর সিট পাবে না। অন্য কোথাও ভর্তি হও।’ এরপর খুলনার দৌলতপুর কলেজে (বর্তমান সরকারি বিএল কলেজ) বিজ্ঞান শাখায় ভর্তি হন। এই কলেজ থেকেই আইএসসি ও বিএসসি পাশ করেন। কলেজ হোস্টেলে থাকতেন। সেই সময় খুলনা থেকে প্রথমে ট্রেনে কলকাতা যেতেন। ট্রেন পাল্টে সুরমা মেইলে সিলেটে। রেলস্টেশনে নেমে হাওর পেরিয়ে হবিগঞ্জে যেতেন। ছোট বেলায় খুব ভালো ফুটবলার ছিলেন। এক-দুবার মোহনবাগান দলেও সুযোগ পেয়েছিলেন ফুটবল খেলার।
চিত্ত রঞ্জন দত্ত ১৯৫১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৫১ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত প্রশিক্ষণ নেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে বাঙালিদের খুব ভালো অবস্থানে ছিল না। সে সময় তিনি একমাত্র বাঙালি হিন্দু অফিসার ছিলেন। কিছুদিন পর সেকেন্ড লেফটেনেন্ট পদে কমিশন পান। ১৯৬৫ সালে চট্টগ্রামের পাহাড়ী এলাকা আসালংয়ে পাক-ভারত যুদ্ধ হয়েছিল। তখন তিনি সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন, কুমিল্লায় পোস্টেড। কম্পানি কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। জীবনে প্রথম যুদ্ধে লড়েন তিনি। এই যুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে হারিয়ে আসালং মৌজা পুনর্দখল করেছিলেন। এই বিরত্বের জন্য তিনি পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে পুরস্কারও পেয়েছিলেন।
১৯৭১ সালের জানুয়ারিতে ছুটি নিয়ে হবিগঞ্জে এলেন। তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সিক্স ফ্রন্টিয়ার্সের বেঙ্গল রেজিমেন্টের সিনিয়র মেজর। ২৫ মার্চের কালরাতের হানাদার বাহিনীর গণহত্যা নিজ চোখে দেখলেন। যা তাঁকে ব্যথিত করে। এরপর বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে উদ্দীপ্ত হয়ে সি আর দত্ত যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে। ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হওয়ার পর তাজউদ্দীন আহমেদকে প্রধানমন্ত্রী মনোনীত করা হয় এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি হিসেব দায়িত্ব দেয়া হয় এম এ জি ওসমানীকে। যুদ্ধ পরিচালনার জন্য তিনি বাংলাদেশকে মোট ১১টি সেক্টরে ভাগ করে নেন। ৪ নম্বর সেক্টরের দায়িত্ব দেওয়া হয় সি আর দত্তকে। ভারতের মেঘালয়ের ডাউকি থেকে আগরতলার খোয়াই পর্যন্ত, মানে খোয়াই-শায়েস্তাগঞ্জ রেললাইন ছাড়া পূর্ব ও উত্তর দিকে সিলেটের ডাউকি সড়ক; হবিগঞ্জ থেকে দক্ষিণ কানাইঘাট পুলিশ স্টেশন পর্যন্ত প্রায় ১০০ বর্গমাইল জুড়ে এই সেক্টর। এটি পাহাড়ি এলাকা। একদিকে গেরিলাযুদ্ধের জন্য যেমন এটি অত্যন্ত উপযুক্ত এলাকা, তেমনি দুর্গমও ছিল। সেক্টরে গেরিলা যোদ্ধা ছিলেন প্রায় ৯ হাজার। ওই এলাকার বিভিন্ন স্থানে ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অবস্থান। সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পর সিলেটের রশীদপুরে প্রথমে ক্যাম্প বানান তিনি। পরবর্তী সময়ে তিনি যুদ্ধের আক্রমণের সুবিধার্থে রশীদপুর ছেড়ে মৌলভীবাজারে ক্যাম্প স্থাপন করেন। ওই সেক্টরে হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের বহু যুদ্ধ সংঘটিত হয়, যার বেশ কয়েকটিতে নিজেই নেতৃত্ব দেন সি আর দত্ত।
১৯৭২ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর চিত্ত রঞ্জন দত্ত স্বাধীন বাংলাদেশে রংপুরে ব্রিগেড কমান্ডার হিসেবে নিযুক্ত হন। সেখানে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য সীমান্ত রক্ষা প্রহরী গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে সরকার। এই বিষয়ে সি আর দত্তকে দায়িত্ব দেয় বাংলাদেশ সরকার। পরবর্তীকালে তিনি সীমান্ত রক্ষা প্রহরী গঠন করেন এবং নাম দেন বাংলাদেশ রাইফেলস (বিডিআর)। বর্তমানে এ বাহিনীর নাম বর্ডার গার্ড অব বাংলাদেশ (বিজিবি)। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ রাইফেলসের প্রথম ডাইরেক্টর জেনারেল (ডিজি)। এছাড়া ১৯৭১-এর পর থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত তাঁকে নানা ধরনের দায়িত্ব পালন করতে হয়। ১৯৭৪ সাল থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত তিনি হেড কোয়ার্টার চিফ অব লজিস্টিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৭ সালে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন। ১৯৭৯ সালে বিআরটিসির চেয়ারম্যান হিসেবে কিছু দিন দায়িত্ব পালনের পর ১৯৮২ সালে তিনি পুনরায় মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। মেজর জেনারেল হিসেবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে ১৯৮৪ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করার পর থেকে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। তিনি এই সংগঠনের আজীবন সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তিনি বীরউত্তম খেতাবে ভ‚ষিত হন। তাঁকে সম্মানিত করার জন্য ঢাকার কাঁটাবন থেকে কারওয়ান বাজার সিগন্যাল পর্যন্ত সড়কটি ‘বীরউত্তম সি আর দত্ত’ সড়ক নামে নামকরণ করা হয়।
বেশ কয়েক বছর ধরেই বড় মেয়ে ও ছেলের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে বসবাস করে আসছিলেন সি আর দত্ত। ২০১৯ সালের শেষ দিক থেকে ফ্লোরিডায় ছোট মেয়ের বাসায় চলে আসেন। মার্চে করোনা ভাইরাসের প্রকোপ বাড়লে নিউইয়র্কে না ফিরে তিনি ফ্লোরিডাতেই থেকে যান। মৃত্যুর তিন দিন আগে বাসার বাথরুমে পড়ে গিয়ে ডান পায়ের গোড়ালি ভেঙে যায়। হাসপাতালে নেওয়ার পর পায়ে অস্ত্রোপচার করা হয়। সে সময় তাঁকে সম্পূর্ণ অজ্ঞান করতে হয়েছিল। তিনি ছিলেন অ্যাজমার রোগি। অপারেশনের পর তাঁর শ্বাসকষ্ট মারাত্মকভাবে বেড়ে যায়, কিডনিও অচল হয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত ফ্লোরিডায় বয়েন্টনবিচের বেথেসডা সাউথ হাসপাতালের হসপিস কেয়ার ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৫ আগস্ট ২০২০ বাংলাদেশ সময় সকাল ৯টায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। বয়স হয়েছিল ৯৩ বছর। তাঁর ইচ্ছা ছিলো প্রিয় মাতৃভ‚মিতেই হবে তাঁর শেষ বিদায়ের কাজ।
সেই ইচ্ছার প্রতি সম্মান জানিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার সি আর দত্তের মরদেহ ৩১ আগস্ট দেশে আনা হয়। বিমানবন্দর থেকে মরদেহ সিএমএইচের মরচ্যুয়ারিতে নেওয়া হয়। সেখান থেকে ডিওএইচএসের বাসায়। ১ সেপ্টেম্বর সকালে বনানী ও ঢাকেশ্বরী মন্দিরে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে চির বিদায় জানানো হয় বীর মুক্তিযোদ্ধাকে। দেওয়া হবে গার্ড অব অনার। সেখানে ঘন্টা দুয়েক রাখার পর রাজধানীর বাসাবো-সবুজবাগ এলাকার শ্রী শ্রী বরদেশ্বরী কালীমাতা মন্দিরে নেওয়া হয় শেষকৃত্যের জন্য।
সি আর দত্তের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘‘মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান জাতি চিরদিন শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে।” প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর শোকবার্তায় বলেন, “মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অনন্য অবদান দেশ ও জাতি চিরদিন কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করবে।” যেখানে দেশে থাকা দুষ্কর হয়ে গিয়েছিল, যেখানে সংখ্যালঘু হিসেবে অনেকেই পার্শ্ববর্তী দেশে আশ্রয় নিয়েছিল, যখন লোভ-লালসায় জন্মভ‚মি ছেড়ে অনেকে পাকিস্তানকে সমর্থন করে হত্যাযজ্ঞে মেতেছিল সেখানে সি আর দত্ত নিঃসন্দেহে একটি বীরত্বের পরিচয় দিয়েছেন।
১৯৫৭ সালের একুশে ফেব্রæয়ারি তিনি বিয়ে করেন। শ্বশুর অনিল কুমার রায় উপমহাদেশের বিখ্যাম রাজনৈতিক ব্যতিক্ত দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের একান্ত সচিব ছিলেন। তাঁরা বিখ্যাত কংগ্রেস পরিবার। স্ত্রী ২০১০ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি এক ছেলে ও তিন মেয়ের জনক ছিলেন। বড় মেয়ে মহুয়া দত্ত নিউইয়র্কে থাকে। মেঝ মেয়ে ব্যারিস্টার চয়নিকা দত্ত থাকে কানাডার টরন্টোতে। ছেলে চিরঞ্জীব দত্ত পেশায় চিকিৎসক থাকেন নিউইয়র্কে। সবার ছোট কবিতা দাস গুপ্ত, কনসালটেন্ট বসবাস ফ্লোরিডায়।
সাহসী ও দুর্জয় ব্যাক্তিত্বের অধিকারী সি আর দত্ত বীরউত্তম ছিলেন সংখ্যালঘু স¤প্রদায়ের অধিকার আদায়ের অগ্রদূত। আলোর দিশারি এবং অসা¤প্রদায়িক বাঙালির এক উজ্জল দৃষ্টান্ত। তাঁর আজন্ম লালিত স্বপ্ন ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ভাসিত অসা¤প্রদায়িক বাংলাদেশ। কর্মই মানব জীবনের সফলতার গল্প নির্মাণ করে। কর্মই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। কর্মের কারণেই যুগে যুগে ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। যা স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে থাকে। সি আর দত্তের ইচ্ছা ছিল তাই জীবনের মায়া আর পরিবারের ভালবাসা ছিন্ন করে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তাঁর অবদান জাতি কৃতজ্ঞতার সাথে মনে করবে। সাথে সাথে তাঁর জীবনী ও অবদান যুগে যুগে দেশপ্রেমে অনুপ্রেরণা যোগাবে।