খুলনার কৃতিসন্তান এ্যাডভোকেট এস.এম. আমজাদ হোসেন ১৯৬২ সালে প্রাদেশিক আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ছিলেন তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষামন্ত্রী। তাঁর হাত ধরেই এ অঞ্চলের নামী-দামী শত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছে। ছিলেন এক জন ভাষাসৈনিকও। আজম খান কমার্স কলেজ ও সিটি ল’ কলেজের একজন প্রথিতযশা শিক্ষকও। ছিলেন খুলনা আইন বারের এক নম্বর সদস্য ও ফৌজদারি আইনের দিকপাল। বিজ্ঞ আইনজীবী ছাড়াও তিনি একাধারে সমাজসেবক, শিক্ষানুরাগী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব।
আমজাদ হোসেন ১৯২৯ সালের ৩ মার্চ রূপসা থানার আইচগাতী ইউনিয়নের দেয়াড়া গ্রামে সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম মরহুম এস এম ইসমাইল হোসেন, মাতা মরহুমা মেহেরুন নেছা। পিতা ছিলেন বৃটিশ শাসনামলে অবিভক্ত ভারতের এক জন দক্ষ পুলিশ কর্মকর্তা। ১৯৭১ সালের ২৪ এপ্রিল বাগেরহাটের কাড়াপড়ায় পাকহানাদার বাহিনী লাইনে দাড়িয়ে বাঙালিদের ওপর গুলি ছোঁড়ে। সেই গুলিতে শহিদ হন ইসমাইল হোসেন। মা মমতাজ রওশন জাহান ছিলেন জমিদার খান বাহাদুরের কন্যা। তাঁরা তিন ভাই তিন বোন। বড় ভাই স্বনামধন্য প্রয়াত কবি আবুল হোসেন (২০১৪ সালে ঢাকায় মারা যান)। বক্তিগত জীবনে আমজাদ হোসেন চার ছেলে ও চার মেয়ে সন্তানের জনক ছিলেন। বড় মেয়ে মরহুম আফরোজা হোসেন ঝর্ণা, মেঝ আফরিন হোসেন রত্মা, সেজ আরিফা হোসেন স্বপ্না ও ছোট মেয়ে আফসানা হোসেন সুপর্ণা এবং বড় পুত্র সন্তান মরহুম এস এম ফিরোজ হোসেন, মেঝ এস এম ফরিদ হোসেন, সেজো এস এম আরিফ হোসেন এবং তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী এস এম সোহেল রানা হোসেন। প্রথম মেয়াদে (১৯৯৬-২০০১) আওয়ামী লীগ সরকারের সময় আমজাদ হোসেনের ভাগ্নে মুহাম্মদ নুরুল হুদা বাংলাদেশ পুলিশের ১৭তম পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ছিলেন (৭ জুন ২০০০ থেকে ৬ নভেম্বর ২০০১ পর্যন্ত)।
১৯৪৪ সালে খুলনা মহানগরীর বিকে ইউনিয়ন ইনস্টিটিটিউশন থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন আমজাদ হোসেন। দুই বছর পর কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এন্ট্রান্স (আইএ) পাস করেন। ১৯৮৭ সালে দেশ ভাগের পরে দৌলতপুরের বিএল কলেজ থেকে ¯œাতক ডিগ্রি লাভ করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং ১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি পাশ করেন। পরে ১৯৫৪ সালে বার কাউন্সিল থেকে পাশ করেন তিনি।
বার কাউন্সিল থেকে পাশ করার পর আমজাদ হোসেন ঢাকা হাইকোর্ট অল্প দিন প্রাকটিস করে খুলনার জর্জ আদালতে যোগদান করেন আইনজীবী হিসেবে। ভালোবাসার টানে নিজ এলাকায় এসে আপন ক্যারিশমার দ্বারা তিনি দেশের একজন প্রখ্যাত আইনজীবী হিসেবে সুনাম অর্জন করেন। পরে খুলনা আইন বারের সভাপতিও হন। এর আগে ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনের জন্য প্রতিষ্ঠিত খুলনা তমুদ্দিন মজলিস প্রতিষ্ঠা করা হলে তিনি প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত এ দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৫২ সালে তিনি সাতক্ষীরা, বাগেরহাট ও খুলনা জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে জনসভা করে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য জনমত সৃষ্টি করেন।
১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ সালে পর্যন্ত খুলনায় ছাত্র রাজনীতির নেতৃত্ব দেন আমজাদ হোসেন। আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের আগে ১৯৫৭ সালে আমজাদ হোসেন জাহানাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের কমিশনার নির্বাচিত হন। নির্বাচনে তিনি মরহুম এ্যাড. আশাবুর রহমান ও মরহুম আলী হাফেজকে পরাজিত করেন। ছাত্র নেতা হিসেবে ২৭ বছর বয়সের সর্বকনিষ্ঠ কমিশনার ছিলেন তিনি। তখন কমিশনারদের ভোটে সরাসরি ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হতো। ঐ বছর খান এ সবুরকে মাত্র ১ ভোটে হারিয়ে ন্যাপের নেতা মরহুম জব্বার সাহেব ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। জীবনে প্রথম জনপ্রতিনিধি হয়ে আমজাদ হোসেন সাংগঠনিক নেতৃত্ব দেওয়ার দক্ষতা অর্জন করেন। যা পরবর্তীতে তাঁর রাজনৈতিক জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে।
খুলনায় কমার্স কলেজ প্রতিষ্ঠার পর প্রতিদিন সন্ধ্যায় ক্লাস হতো। ১৯৫৩ সাল থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত প্রতিষ্ঠালগ্নে তিনি কমার্স কলেজের খÐকালীন শিক্ষক ছিলেন। বর্তমানে অনেক খ্যাতিমান মানুষ তাঁর ছাত্র। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের শাসনামলে ১৯৬২ সালে প্রদেশিক আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ছিলেন পাকিস্তানের সর্বকনিষ্ঠ মন্ত্রী। বয়স মাত্র ৩৫ বছর। ঐ সময় পূর্ব পাকিস্তানের নয় জন মন্ত্রীর মধ্যে তিনি এক জন ছিলেন। শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে তিনি এ বঙ্গে শিক্ষা প্রসারে দুই শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। অনেক স্কুল-কলেজ জাতীয়করণও করেন তিনি। তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় খুলনা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ (কুয়েট), বয়রা মহিলা কলেজ, টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, ল্যাবরেটরি হাই স্কুল, কয়েজ হাই স্কুল (পাবলিক স্কুল), গার্লস হাই স্কুল (মন্নুজান কলেজ), বেলফুলিয়া হাই স্কুল, আইচগাতী স্কুল, তেরখাদা নর্থ বেঙ্গল কলেজ, শাহাপুর স্কুল, দিঘলিয়া হাইস্কুল, কাজদিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়, গাজিরহাট মাধ্যমিক বিদ্যালয়, পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট (আধুনিকায়ন), খুলনা আলিয়া মাদ্রাসাসহ দক্ষিণপশ্চিম অঞ্চলে ও গোটা দেশে অগণিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়।
১৯৬৭ সালে জাতিসংঘের উদ্যোগে জেনেভায় অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অব পাবলিক এডুকেশন সম্মেলনে পাকিস্তান ডেলিগেশনের নেতা হিসেবে আমজাদ হোসেন যোগদান করেন এবং সম্মেলনে নির্বাচিত ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্লিনারীসেশনে সভাপতিত্ব করেন। শিক্ষামন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জাপান, গণচীন, ইতালী, সুইজারল্যাÐ, মিশরসহ বিভিন্ন দেশ সফর করেন। পরে তিনি মুসলিম লীগের সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন।
তিনি অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননায় ভ‚ষিত হয়েছেন। এরমধ্যে শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য ইউনেস্কো ক্লাব কর্তৃক ২০০৫ সালে আজীবন সম্মাননা পুরস্কার অর্জন করেন। এছাড়া খুলনা আইনজীবী সমিতি’র ৫০ বছর পূর্তী উপলক্ষে সম্মাননা স্মারক ছাড়াও সিটি ল’ কলেজ, কমার্স কলেজ, বিএল কলেজ, মানবাধিকার কমিশন, উমেশচন্দ্র পাবলিক লাইব্রেরি থেকে সম্মাননা স্মারক উল্লেখযোগ্য।
১৯৮০ সালে তিনি খুলনা সিটি ল’ কলেজের সিনিয়র অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। প্রায় মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। তিনি একজন খুব ভালো বক্তা ছিলেন, তাঁর বক্তৃতা মানুষ মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনতো। বই পড়া ছিলো তাঁর একটা নেশা।
আমজাদ হোসেন ২০১৩ সালের ২১ অক্টোবর দুপুর দেড়টায় রাজধানীর কেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৮৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। রাজধানীর ইকবাল রোডে তাঁর প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয় খুলনা নগরীর তাঁর মির্জাপুরের নিজ বাসভবন সংলগ্ন মতি মসজিদের সম্মূখে। তৃতীয় সিটি ল’ কলেজ মাঠে ও চতুর্থ জানাজা শহিদ হাদিস পার্কে অনুষ্ঠিত হয়। এই জানাজায় দলমত নির্বিশেষ খুলনার আপমর মানুষ অংশ নেন। এরপর খুলনা বারের আইনজীবীদের আয়োজনে কোট প্রাঙ্গণে মরহুমের আরও একটি জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। সবশেষ গ্রামের বাড়ি খুলনার দেয়াড়ায় জানাজা শেষে তাঁকে পারিবারিক কবরস্থানে স্ত্রীর কবরের পাশে দাফন করা হয় (স্ত্রী ২০০৮ সালে জানুয়ারি মাসে মারা যান)। আমজাদ হোসেন দীর্ঘ দিন বার্ধক্যজনিত নানা কারণে ভ‚গছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে ১০ম জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে আনীত শোকপ্রস্তাবে বলা হয় এ্যাড. এস এম আমজাদ হোসেনের মৃত্যুতে দেশ একজন প্রবীণ রাজনীতিবিদ, আইনজীবী, ভাষা আন্দোলনের অগ্রপথিক এবং সমাজ সেবককে হারালো।
এস এম আমজাদ হোসেন ছিলেন সৎ, যোগ্য, কর্মঠ এবং স্পষ্টভাসী একজন বলিষ্ঠ কণ্ঠের আদর্শবান রাজনীতিবিদ। খুলনার কেডিএ নিউ মার্কেটের যখন দোকান বরাদ্দ দেওয়া হয় তিনি ছিলেন বরাদ্দ কমিটির সভাপতি। কিন্তু নিজের জন্য একটি দোকানও তিনি রাখেন নি। প্রচার বিমুখ এই মানুষটি ব্যক্তিগত জীবনে একজন ভালো মানের মানুষ হিসেবেও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। রাজনৈতিককর্মী, পেশাগত সহকর্মী ও আত্মীয় স্বজনদের সাথে তাঁর ছিলো উত্তম সম্পর্ক। হাজারো ব্যস্ততার মধ্যেও সকলের খোঁজ খবর রাখতেন প্রতিনিয়ত। অনেক দিন পর প্রিয় কারো সাথে দেখা হলে অবলীলায় বুকে জড়িয়ে ধরতেন তাকে। দুর্নীতি কিংবা স্বজনপ্রীতি তাঁকে কখনও স্পর্শ করতে পারেনি। তাঁকে বলা হয় বৃহত্তর খুলনার শিক্ষা প্রসারের কারিগর। শুধু তাই নয় তিনি জীবদ্দশায় অসংখ্য ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত ছিলেন। বৃহত্তর খুলনার উন্নয়নেরও রয়েছে তাঁর অসামান্য অবদান। তাই আগামীতেও খুলনার মানুষ তাঁর কথা স্মরণ রাখবে তাঁর আদর্শ ও কর্মের মধ্যদিয়ে। #