হৃদয় জীবনকে প্রতিনিয়ত নাড়া দিয়ে যায়। কমবয়সে হৃদয় দেয়া নেয়া অনেকের হৃদয়ে ঝড় তোলে। আবার হৃদয়হীন বলে কখনো কটাক্ষও শুনতে হয়। তোমার মন বলে কিছু নেই, স্ত্রীর এমন কথায় অনেকেই হয়ত নতুন করে নিজেকে নিয়ে ভাবতে বসেন। এমনি হৃদয় নিয়ে এক কাছের আত্মীয়ের রসাত্মক মন্তব্য- কিছুদিন আগে তোমার ভাবীর হৃদয়ে রিং পরিয়ে দিলাম। শ্রোতার সরল জিজ্ঞাসা, আপনি এত রোমাণ্টিক! রোমাণ্টিক মন্তব্যের আসল কথা হল, আপাতত হৃদয়হরণ ঠেকানো গেছে। এভাবে হৃদয় নিয়ে ভাব-ভাষায় যত অলংকারই দেয়া হোক না কেন সত্যিই যদি ট্রানাটানি শুরু হয়, তখন কিন্তু ধকল সামলানো কঠিন। আমরা বলছি হৃদরোগ সম্পর্কে।
হৃদয়কে ইংরেজিতে যখন হার্ট বলি তখন ওটা গুরুত্ব পায়। আমাদের দেশে চল্লিশোর্ধ ব্যক্তিদের মধ্যে প্রায়ই হার্টের বিভিন্ন জটিলতা লক্ষ্য করা যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ১৯৭০ সালের পর উন্নত বিশে^ মৃত্যুহার কমে গেলেও বিশ^ব্যাপী মৃত্যুর অন্যতম কারণ হৃদরোগ। একই সঙ্গে মধ্য ও স্বল্প আয়ের দেশগুলোতেও হৃদরোগে আক্রান্ত রোগী এবং এর কারণে মৃত্যুহার বাড়ছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, বর্তমান বিশে^ সবচেয়ে বেশি মানুষ (৩১ শতাংশ) মারা যাচ্ছেন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে। নিম্ম আর মধ্য আয়ের দেশগুলোতে শতকরা ৮০ শতাংশ মৃত্যুর কারণ হৃদরোগ। বাংলাদেশে বর্তমানে শতকরা প্রায় ৫৩ ভাগ মৃত্যুর কারণ অসংক্রামক রোগ। এর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে হৃদরোগ। চিকিৎসকরা বলছেন, কিছুদিন আগ পর্যন্তও দেশে বয়স্কদের মধ্যে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা ছিল বেশি। তবে গত কয়েক বছরে তরুণ, এমনকি শিশুদের মধ্যেও হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে।
বাংলাদেশে শতকরা ২৭ ভাগ মৃত্যুর কারণ হৃদরোগ। হৃদরোগের অন্যতম কারণ উচ্চ রক্তচাপ। এর পেছনে কোলেস্টেরলের আধিক্য বিশেষভাবে দায়ী। কোলেস্টেরল দুই ধরণের-কম ঘনত্বের কোলেস্টেরল বা এলডিএল এটা হল খারাপ কোলেস্টেরল, যা হৃদপিন্ডের রক্তনালীর দেয়ালে চর্বি জমায়। এতে রক্তনালী সরু হয়ে রক্ত চলাচল বাধাগ্রস্ত করে, ফলে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ে। উচ্চঘনত্বের কোলেস্টেরল বা এইচডিএল যা ভালো কোলেস্টেরল। এটা রক্তের খারাপ কোলেস্টেরলকে রক্ত থেকে যকৃতে বয়ে নিয়ে যায় এবং রক্তনালীর দেয়ালে চর্বি জমতে দেয় না।
আমাদের খাদ্যাভ্যাসে অনেকক্ষেত্রে নিয়ম মেনে না চলার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। দেখা যাচ্ছে যেটা মুখোরোচক কিংবা সহজে বাইরে থেকে কিনে খাওয়া যায় এমন খাবারে অনেকের আগ্রহ রয়েছে, এটা দীর্ঘদিন চলতে থাকলে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি তৈরি করে। শুধু তাই না এর পরিণতিতে হার্টঅ্যাটাক, স্ট্রোক, ক্রনিক কিডনির ডিজিজ কিংবা বুকে ব্যথা প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে। এক্ষেত্রে খাবার সচেতনতা খুব জরুরি। যেমন-নানা ধরণের বেকারি পণ্য- কেক, কুকিজ, পিৎজা এসবে ট্র্রান্সফ্যাট রয়েছে। খাবারের ট্র্রান্সফ্যাট হল ক্ষতিকর চর্বি জাতীয় খাবার। এটি রক্তের ভালো কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে দেয় এবং খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। তাছাড়া প্রক্রিয়াজাত বিভিন্ন রকম খাবার যেমন-ফ্রোজেন খাবার, নানা ধরণের ভাজা পোড়া খাবার, ফ্রাইড চিকেন, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই ইত্যাদি ট্র্রান্সফ্যাটের অন্যতম উৎস।
খাদ্যের স্যাচুরেটেড ফ্যাটও অস্বাস্থ্যকর। এটা মোট কোলেস্টেরল বাড়ায়। নারকেল তেল, পামতেলে প্রচুর পরিমাণে স্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকে। এর বিকল্প হিসেবে জলপাই তেল কিংবা বাদাম তেল উপকারী। এগুলোতে মনোঅ্যানস্যাচুরেটেড ফ্যাট পাওয়া যায়। বাদাম, বাদাম জাতীয় খাবার এবং মাছের তেলে থাকে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, এগুলোও হার্টের জন্য উপকারী।
হৃদরোগ প্রতিরোধে কিছু খাবার আছে যেগুলো কোলেস্টেরলকে নিয়ন্ত্রণে রাখে। ওট হল তেমনি একটি খাবার। ডায়াবেটিস, হৃদরোগের মত জটিল রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখে ওট। প্রতিদিন মাত্র তিন গ্রাম ওট খেলে দেহে কোলেস্টেরলের মাত্রা খুব দ্রুত স্বাভাবিক হয়। সয়াবিনে থাকা আমিষ রক্তের এলডিএল কমিয়ে দেয় এবং এইচডিএল বাড়িয়ে দেয়। কাঠবাদামও করোনারি ডিজিজের ঝুঁকি কমায়। এটি এইচডিএল মাত্রা বাড়ায় ও এলডিএল এর মাত্রা কমিয়ে দেয়। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে সবুজ চা রক্তে কোলেস্টেরলের উচ্চমাত্রা, উচ্চচাপ ও রক্ত জমাট বাঁধা প্রতিহত করে। সুস্বাস্থ্যের জন্য বিশেষ করে হৃদপিণ্ড সুস্থ রাখার অনন্য উপাদান হল বার্লি। রক্তে উচ্চমাত্রার কোলেস্টেরল ১৫ শতাংশ কমিয়ে আনার ক্ষমতা আছে বার্লিতে।
নিয়মতান্ত্রিক জীবন যাপনের সাথে সাথে সুষম খাবার গ্রহণে হৃদয়ের অসুখ ঠেকিয়ে রাখা যায়। ইসবগুল হল আঁশ জাতীয় এমন উপকারী খাবার, যা শরীর বৃত্তির বিপাকীয় ক্রিয়ার মাধ্যমে হৃদপিণ্ড কে সুস্থ রাখে। খাদ্যের স্যাচুরেটেড ফ্যাটও অস্বাস্থ্যকর। খেজুরে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম, যা স্ট্রোকের ঝুঁকি ৪০% কমিয়ে দেয়। প্রতিদিন নিয়মিত খেজুর খেলে খারাপ কোলেস্টেরল কমায় এবং ভাল কোলেস্টরলের মাত্রা বাড়ায়।
শরীর ফিট রাখতে ও সুস্থতায় পরিশ্রমের কোন বিকল্প নেই। এর জন্য নিয়মিত ব্যায়াম জরুরি। হাঁটা একটি প্রাকৃতিক চিকিৎসা পদ্ধতি যা পাশর্^প্রতিক্রিয়া মুক্ত। নিয়মিত হাঁটার অভ্যাস হৃদরোগ প্রতিরোধে বড় ভ‚মিকা রাখে। এতে মাংসপেশী সচল থাকে এবং রক্ত চলাচল বৃদ্ধি পায়। এক্ষেত্রে রক্তনালীর অধিকতর সংকোচন প্রসারণে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে। হাঁটার ফলে শক্তি ব্যয় হয়, ফলে ওজন বাড়তে পারে না। আর রক্তে চর্বি ও সুগারের পরিমাণও ঠিক থাকে। সাইকেল চালনা তেমনি একটি ব্যায়াম, ক্যালরি খরচ করে শরীরকে ফিট রাখতে যার জুড়ি নেই। গবেষকরা দেখেছেন প্রতিদিন ঘন্টাখানেক সাইকেল চালালে শক্তি ব্যয় হয় তিনশ’ ক্যালরি। আর যারা নিয়মিত সাইক্লিং করেন তাদের হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার হারও বেশ কম।
মনের সঙ্গে হৃদপিÐের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। দুশ্চিন্তা, হতাশা, মানসিক চাপ হার্টের জন্য ক্ষতিকর। তাই এসব এড়াতে মনের ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা জরুরি। নিয়মিত মেডিটেশন মনের চাপ দূর করে। এছাড়া হাসি খুশি থাকতে হবে। পর্যাপ্ত ঘুমানো এবং পছন্দের কোন কাজে বিশেষ করে শখের কাজে সময় দিতে পারলে জীবনকে অর্থপূর্ণ বলে মনে হবে।
লেখক: সিনিয়র তথ্য অফিসার, আঞ্চলিক তথ্য অফিস, খুলনা।