জন্মভূমি ডেস্ক : বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি ব্যক্তি খাত। এ খাতের ভোগ ব্যয় সাধারণত মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ৬৮ থেকে ৭০ শতাংশ অবদান রাখে। এছাড়া বিনিয়োগ ব্যয়ের (গ্রস ক্যাপিটাল ফর্মুুলেশন) অবদান ৩০ শতাংশের আশপাশে। তবে গত অর্থবছর এ দুই খাতের প্রবৃদ্ধিতেই বড় ধরনের ধস নামে। করোনাকালীন বছরের চেয়েও কমে গেছে ভোগ ও বিনিয়োগ ব্যয়ে প্রবৃদ্ধি। ফলে সরকারি ব্যয়ে ভালো প্রবৃদ্ধি হলেও সার্বিকভাবে ২০২২-২৩ অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার হ্রাস পেয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। এতে দেখা যায়, গত অর্থবছর ব্যক্তি খাতের ভোগ ব্যয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র এক দশমিক ৯৮ শতাংশ। যদিও করোনাকালীন বছর অর্থাৎ ২০১৯-২০ অর্থবছর ব্যক্তি খাতের ভোগ ব্যয়ে প্রবৃদ্ধির হার ছিল তিন শতাংশ। ওই অর্থবছর করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে ৬৬ দিন সাধারণ ছুটি ছিল। জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহে সব প্রতিষ্ঠান ও কলকারখানা খোলার অনুমতি দেয়া হলেও অর্থনৈতিক কার্যক্রম চলে সীমিত আকারে।
করোনা নিয়ন্ত্রণে পরের এক বছর পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের বিধিনিষেধ ছিল। এরপরও ২০২০-২১ অর্থবছর ব্যক্তি খাতের ভোগ ব্যয়ে প্রবৃদ্ধি বেড়ে দাঁড়ায় আট দশমিক ০২ শতাংশ। আর ২০২১-২২ অর্থবছর অর্থনৈতিক কার্যক্রম পুরোপুরি স্বাভাবিক থাকায় ব্যক্তি খাতের ভোগ ব্যয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল সাত দশমিক ৪৮ শতাংশ। এ হিসাবে আগের দুই অর্থবছরের তুলনায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে ব্যক্তি খাতে ভোগ ব্যয়ের প্রবৃদ্ধি চার ভাগের এক ভাগে নেমেছে।
এ মূল কারণ কী হতে পারে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, মূল্যস্ফীতি যে হারে বাড়ছে তাতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। মূলত এর প্রভাব দেখা গেছে ব্যক্তি খাতের ভোগ ব্যয়ে। আয় যে হারে বাড়ছে, জিনিসপত্রের দাম তার চেয়ে অনেক বেশি হারে বাড়ছে। আয় ও মূল্যস্ফীতির মধ্যে কোনো সামঞ্জস্য নেই। এতে মানুষের প্রকৃত আয় কমে গেছে; যা ব্যক্তি খাতের ভোগ ব্যয়ে প্রবৃদ্ধি হ্রাসের অন্যতম কারণ।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে আয়ের তথ্য সেভাবে প্রকাশ করা হয় না। তবে ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে শ্রমশক্তি জরিপের যে ফলাফল প্রকাশ করা হয় তাতে দেখা যায়, কর্মসংস্থান খুব একটা কমেনি বা বেকারত্ব খুব একটা বাড়েনি। তার মানে আয়ের প্রভাব পড়ছে ভোগ ব্যয়ে। তবে কর্মসংস্থান যেসব খাতে হচ্ছে, তা মূলত কম আয়নির্ভর। উচ্চ আয়ের খাত তথা শিল্পে নতুন কর্মসংস্থান হচ্ছে খুবই কম। মূলত কৃষিতে নতুন কর্মসংস্থান বেশি হয়েছে। তবে এ খাতে আয়ের পরিমাণ তুলনামূলক কম। এটিও ভোগ ব্যয়ে প্রভাব ফেলছে।
বিবিএসের তথ্যমতে, গত অর্থবছর ব্যক্তি খাতের ভোগ ব্যয়ে প্রবৃদ্ধি কম হলেও সরকারি খাতে ভোগ ব্যয়ে ভালো প্রবৃদ্ধি হয়েছে; যার হার ছিল আট দশমিক ৫৪ শতাংশ। এর আগের অর্থবছর সরকারি ভোগ ব্যয়ে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ছয় দশমিক ২৪ শতাংশ, ২০২০-২১ অর্থবছর ছয় দশমিক ৮৮ শতাংশ এবং ২০১৯-২০ অর্থবছর এক দশমিক ৯৫ শতাংশ। করোনা সংক্রমণ শুরুর পর ওই অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধে সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। মূলত এ প্রভাব পড়েছিল ২০১৯-২০ অর্থবছরের সরকারি ভোগ ব্যয়ে।
এদিকে ২০২২-২৩ অর্থবছর বিনিয়োগ ব্যয়ে প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র দুই দশমিক ২১ শতাংশ, যা করোনাকালীন বছরের চেয়ে কম। ২০১৯-২০ অর্থবছর বিনিয়োগ ব্যয়ে প্রবৃদ্ধির হার ছিল তিন দশমিক ৯৫ শতাংশ। আর ২০২০-২১ অর্থবছর বিনিয়োগ ব্যয়ে প্রবৃদ্ধি হয় আট দশমিক ০৯ শতাংশ ও ২০২১-২২ অর্থবছর ১১ দশমিক ৬৫ শতাংশ। ডলার সংকটে আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপকেই গত অর্থবছর বিনিয়োগে নিম্নমুখী প্রবৃদ্ধির মূল কারণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এ প্রসঙ্গে ড. জাহিদ হোসেন বলেন, গত অর্থবছর ডলার সংকটের কারণে আমদানিতে যে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছিল তার প্রভাব দেখা গেছে আমদানি প্রবৃদ্ধিতে। এ খাতে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির পরও বিনিয়োগ ব্যয় তথা গ্রস ক্যাপিটাল ফর্মুলেশনে দুই দশমিক ২১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অনেক বেশি। কারণ বাংলাদেশে মূলধনি যন্ত্রপাতি উৎপাদন হয় না। এর পুরোটাই আমদানি করতে হয়। আর গত অর্থবছর এলসি খোলায় কড়াকড়ি আরোপের কারণে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে ধস নামে।
প্রসঙ্গত, গত অর্থবছর পণ্য ও সেবা আমদানিতে ৯ দশমিক ৭৭ শতাংশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি ছিল। যদিও এর আগের অর্থবছর (২০২১-২২) আমদানিতে রেকর্ড ৩১ দশমিক ১৮ শতাংশ ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়। আর ২০২০-২১ অর্থবছর আমদানি প্রবৃদ্ধি ছিল ১৫ দশমিক ২৭ শতাংশ। তবে করোনা সংক্রমণের প্রভাবে ২০১৯-২০ অর্থবছর আমদানি প্রবৃদ্ধিতে ধস নেমেছিল। ওই অর্থবছর ১১ দশমিক ৪১ শতাংশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয় আমদানিতে।
২০১৯-২০ অর্থবছর রপ্তানিতেও ধস নেমেছিল। করোনার কারণে চলা বিশ্বব্যাপী লকডাউন ও আমদানিতে বিভিন্ন দেশের বিধিনিষেধ আরোপের কারণে ওই অর্থবছর রপ্তানি কমেছিল সাড়ে ১৭ শতাংশ। তবে করোনার প্রকোপ কমতে থাকায় ২০২০-২১ অর্থবছর রপ্তানিতে ৯ দশমিক ১৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়। ২০২১-২২ অর্থবছর তা বেড়ে দাঁড়ায় রেকর্ড ২৯ দশমিক ৩৯ শতাংশ। তবে গত অর্থবছর ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্বব্যাপী মন্দার কারণে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়ায় আট দশমিক ০৩ শতাংশ।
সার্বিকভাবে গত অর্থবছর জিডিপি প্রবৃদ্ধিও হার কমে দাঁড়িয়েছে পাঁচ দশমিক ৭৮ শতাংশ, যা করোনাকালীন বছর বাদ দিলে ১৪ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। করোনার কারণে ২০১৯-২০ অর্থবছর জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল তিন দশমিক ৪৫ শতাংশ। তবে স্বাভাবিক বছর বিবেচনায় গত অর্থবছরের চেয়ে কম প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ২০০৮-০৯ অর্থবছর। ওই অর্থবছর জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল পাঁচ দশমিক ৭৪ শতাংশ। এরপর টানা ১০ বছর ছয় শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
এদিকে ২০২০-২১ অর্থবছর ছয় দশমিক ৯৪ শতাংশ ও ২০২১-২২ অর্থবছর সাত দশমিক ১০ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। তবে অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যেও পাঁচ দশমিক ৭৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি খারাপ নয় বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।