জন্মভূমি ডেস্ক : সোয়েটার প্রতি পিস রপ্তানির ঘোষণা দেয়া হয়েছে শূন্য দশমিক ৮৭ ডলার; যা বাংলাদেশি টাকায় ৯৫ টাকা ৭০ পয়সা। আর প্রতি পিস অন্তর্বাস ঘোষণা দেয়া হয়েছে দশমিক শূন্য দশমিক ২১ ডলার, যা বাংলাদেশি টাকায় ২৩ টাকা ১০ পয়সা। অনেকটা পানির দামে সোয়েটার আর অন্তর্বাস রপ্তানির ঘোষণা দিয়েছেন রপ্তানিকারক। তবে ঘোষণা দেয়া সোয়েটার বা অন্তর্বাস নয়, রপ্তানি হচ্ছে ডেনিম বা জিনসের প্যান্ট। যদিও প্রতি পিস প্যান্ট চার থেকে পাঁচ ডলারে (বাংলাদেশি টাকায় ৪৪০ থেকে ৫৫০ টাকা) রপ্তানি হয়। জালিয়াতির মাধ্যমে দুই কনটেইনার জিনসের প্যান্ট রপ্তানি হচ্ছে সৌদি আরব। শুধু তা-ই নয়, রপ্তানিকারকের ঘোষিত পণ্যের পরিমাণের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি পণ্য পাওয়া গেছে। রপ্তানি হয়ে গেলে দেশ থেকে পাচার হয়ে যেত প্রায় আট কোটি ৭৪ লাখ টাকা। নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার ফাইয়্যাজ ফ্যাশন লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান রপ্তানিতে এমন জালিয়াতি করেছে। রপ্তানির সব প্রক্রিয়া শেষ করে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস। আর কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের তৎপরতায় শেষ পর্যন্ত জালিয়াতি ধরা পড়ে। কাস্টমস গোয়েন্দা বলছে, কাস্টম হাউসের কর্মকর্তারা পণ্য না দেখেই পণ্য ঝুঁকিমুক্ত বলে রপ্তানির অনুমতি দিয়েছেন। প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আঁতাত করে রপ্তানির অনুমতি দেয়া এসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিত। এই রপ্তানিকারকের প্রথম কনটেইনার আটকের পর জালিয়াতি ধরা পড়ে। কাস্টম হাউসকে প্রতিবেদন দেয়া হলেও ব্যবস্থা নেয়নি।
এনবিআর সূত্রমতে, ফাইয়্যাজ ফ্যাশন লিমিটেড সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট আনমন এজেন্সির মাধ্যমে পণ্য রপ্তানির জন্য ২৯ ডিসেম্বর বিল অব এন্ট্রি দাখিল করে। যাতে একটি কনটেইনারে ঘোষণা দেয় হয় ১৪ হাজার ৩৫০ পিস পণ্য। এর মধ্যে ১২ হাজার পিস সুয়েটার ও দুই হাজার ৩৫০ পিস অন্তর্বাস। এতে প্রতি পিস সোয়েটার রপ্তানি মূল্য ঘোষণা করা হয় শূন্য দশমিক ৮৭ ডলার, যা বাংলাদেশি টাকায় ৯৫ টাকা ৭০ পয়সা (এক ডলারে ১১০ টাকা হিসেবে)। আর প্রতি পিস অন্তর্বাস ঘোষণা দেয় হয় শূন্য দশমিক ২১ ডলার, যা বাংলাদেশি টাকায় ২৩ টাকা ১০ পয়সা। সে হিসেবে ১৪ হাজার ৩৫০ পিস সোয়েটার ও অন্তর্বাসের রপ্তানিমূল্য দাঁড়ায় প্রায় ১২ লাখ দুই হাজার টাকা (সোয়েটার প্রায় সাড়ে ১১ লাখ টাকা ও অন্তর্বাস প্রায় ৫৪ হাজার টাকা)। চালানটির শুল্কায়ন প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। রাজস্ব কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান অ্যাসাইকুডা সিস্টেমে তা গ্রিন (রপ্তানির জন্য ঝুঁকিমুক্ত হিসেবে অনুমতিপ্রাপ্ত) করেছেন।
চট্টগ্রামের বেসরকারি ডিপো শফি মোটরস থাকা কনটেইনার শুল্কায়ন শেষে রপ্তানির জন্য প্রস্তুত। কিন্তু গোপন তথ্যের ভিত্তিতে চালানের রপ্তানি স্থগিত করে কাস্টমস গোয়েন্দা। পরে ১৫ জানুয়ারি কনটেইনার থাকা পণ্য শতভাগ কায়িক পরীক্ষা করা হয়। এতে সোয়েটার বা অন্তর্বাস কিছুই পাওয়া যায়নি। কনটেইনারে পাওয়া গেছে ৮৫ হাজার ৩৬৮ পিস ডেনিম বা জিনসের প্যান্ট (ডেনিম লং প্যান্ট)। প্রতি পিস জিনসের প্যান্টের (বড়) রপ্তানি মূল্য পাঁচ ডলার, বাংলাদেশি টাকায় ৫৫০ টাকা। সে হিসাবে এই কনটেইনারে পাওয়া জিন্স প্যান্টের মূল্য প্রায় চার কোটি ৬৯ লাখ টাকা। হিসাব অনুযায়ী, এই কনটেইনারে রপ্তানিকারকের ঘোষণা অনুযায়ী পণ্যের মূল্য ছিল প্রায় ১২ লাখ টাকা। কিন্তু রপ্তানি হচ্ছে প্রায় চার কোটি ৬৯ লাখ টাকার পণ্য। অর্থাৎ পণ্য রপ্তানি হলেও প্রায় চার লাখ ৫৭ হাজার টাকা দেশে আসত না। আবার রপ্তানিকারক ঘোষণা দিয়েছে ১৪ হাজার ৩৫০ পিস। কিন্তু পাওয়া গেছে ৮৫ হাজার ৩৬৮ পিস। অর্থাৎ ঘোষণার অতিরিক্ত ৭১ হাজার ১৮ পিস বেশি পণ্য রপ্তানি হয়ে যেত।
অপরদিকে, চালানটির শুল্কায়নের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কাস্টম হাউসের কমিশনারকে ২৪ জানুয়ারি চিঠি দেয় কাস্টমস গোয়েন্দা। চিঠিতে জালিয়াতি করা রপ্তানিকারক ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করা হয়। চিঠিতে বলা হয়, রাজস্ব কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান বিল অব এক্সপোর্ট, কমার্শিয়াল ইনভয়েস ও প্যাকিং লিস্টে সই করেছেন, কিন্তু তারিখ দেননি। এছাড়া অ্যাসেসমেন্ট অফিসার হিসেবে বিল অব এক্সপোর্টটি শুল্কায়ন করেন তিনি। চালানটি ১০ থেকে ১৫ শতাংশ কায়িক পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দিতে এই রাজস্ব কর্মকর্তাকে নির্দেশনা দেয়া হয়। তিনি ইনভয়েস ও প্যাকিং লিস্টের ঘোষণা অনুযায়ী সামঞ্জস্য পাওয়া গেছে বলে তিনি প্রতিবেদন দিয়েছেন। তবে বিল অব এক্সপোর্টে পণ্যের ঘোষিত আইটেম দুইটি হলেও ইনভয়েস আর প্যাকিং লিস্টে একটি মাত্র আইটেম পেয়েছে কাস্টমস গোয়েন্দা। অর্থাৎ রপ্তানিকারকের সঙ্গে আঁতাত করে পণ্যের কায়িক পরীক্ষা না করেই প্রতিবেদন দিয়েছেন এই রাজস্ব কর্মকর্তা। ঘোষণা বহির্ভূত ও ঘোষণা অতিরিক্ত পণ্য পাওয়া গেলেও ডিপোর রাজস্ব কর্মকর্তা অ্যাসাইকুডায় পণ্যটি গ্রিন করেছেন, সেজন্য তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চিঠিতে অনুরোধ করা হয়েছে।
অপরদিকে, কাস্টমস গোয়েন্দা কর্মকর্তারা একই রপ্তানিকারকের অপর একটি কনটেইনার কায়িক পরীক্ষা করেন। একই ডিপোতে থাকা ওই কনটেইনারের পণ্যও রপ্তানি হচ্ছে সৌদি আরবে। এই কনটেইনারে রপ্তানিকারকের ঘোষিত পণ্য ছিল ১২ হাজার ১৫০ পিস সোয়েটার ও দুই হাজার ২০০ পিস অন্তর্বাস। এতে প্রতি পিস সোয়েটার রপ্তানি মূল্য ঘোষণা করা হয় শূন্য দশমিক ৮৭ ডলার, যা বাংলাদেশি টাকায় ৯৫ টাকা ৭০ পয়সা (এক ডলারে ১১০ টাকা হিসেবে)। আর প্রতি পিস অন্তর্বাস ঘোষণা দেয় হয় শূন্য দশমিক ২১ ডলার, যা বাংলাদেশি টাকায় ২৩ টাকা ১০ পয়সা। সে হিসাবে ১২ হাজার ১৫০ পিস সোয়েটার ও অন্তর্বাসের রপ্তানিমূল্য দাঁড়ায় প্রায় ১২ লাখ ১৩ হাজার টাকা (সোয়েটার প্রায় সাড়ে ১১ লাখ ৬২ হাজার টাকা ও অন্তর্বাস প্রায় ৫০ হাজার টাকা)। কিন্তু কায়িক পরীক্ষায় কনটেইনারে পাওয়া গেছে ৬৮ হাজার ৪৪৮ পিস বড় জিন্স প্যান্ট ও নয় হাজার ৩৬০ পিস ছোট জিন্স প্যান্ট। মোট ৭৭ হাজার ৮০৮ পিস প্যান্টের রপ্তানিমূল্য দাঁড়ায় প্রায় চার কোটি ১৭ লাখ টাকা (বড় প্রতি পিস পাঁচ ডলার বা ৫৫০ টাকা, ছোট প্রতি পিস চার ডলার বা ৪৪০ টাকা)। হিসাব অনুযায়ী, রপ্তানিকারক ঘোষিত পণ্যের মূল্য ছিল প্রায় ১২ লাখ ১৩ হাজার। কিন্তু কায়িক পরীক্ষাপ্রাপ্ত জিন্স প্যান্টের রপ্তানিমূল্য প্রায় চার কোটি ১৭ লাখ টাকা। অর্থাৎ রপ্তানিকারক এই কনটেইনার রপ্তানি করতে পারলে পাচার হতো বা দেশে আসতো না প্রায় চার কোটি পাঁচ লাখ টাকা। এই চালানটিও রাজস্ব কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান শুল্কায়ন করে রপ্তানির অনুমতি দিয়েছেন। এই চালানেও জালিয়াতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কমিশনারকে ৪ ফেব্রুয়ারি প্রতিবেদন দিয়েছে কাস্টমস গোয়েন্দা।
কাস্টমস গোয়েন্দার একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, জালিয়াতি করা প্রতিষ্ঠান ও কর্মকর্তার বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবেদন দেয়ার পরও ব্যবস্থা নেয়নি কাস্টম হাউস। পরের কনটেইনারেও একই জালিয়াতি ধরা পড়েছে। কর্মকর্তা কায়িক পরীক্ষা না করেই প্রতিবেদন দিয়েছে, যাতে পণ্য রপ্তানি হয়ে যেত। রপ্তানিতে জালিয়াতি রোধে প্রতিষ্ঠান, সিঅ্যান্ডএফ ও শুল্কায়নকারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ করা হয়েছে।
২৩ টাকার অন্তর্বাস দেখিয়ে ৫৫০ টাকার প্যান্ট রপ্তানি!
Leave a comment