জন্মভূমি ডেস্ক : রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংকের ঋণের টাকা খেলাপি হওয়া দিন দিন বাড়ছে। কারণ নথিপত্র ছাড়া নামে-বেনামে ঋণ দেয়ায় ঋণের টাকা আদায় করতে পারছে না ব্যাংকগুলো। তাই এসব খেলাপি ঋণের অর্থ আদায়ে মামলা করছে ব্যাংকগুলো। তবে মামলা করেও অর্থ আদায় করতে পারছে না। ২০২৩ সাল শেষে খেলাপি ঋণ আদায়ে রাষ্ট্রায়ত্ত এসব ব্যাংকের বিভিন্ন আদালতে মামলার সংখ্যা হয়েছে ৪৯ হাজার ১১৬টি। এসব মামলায় জড়িত অর্থের পরিমাণ ৮৭ হাজার ২৯৮ কোটি টাকা। অর্থঋণ আদালতেই বেশিরভাগ জড়িত অর্থ আটকে রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও ব্যাংকগুলোর সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।
ব্যাংকগুলো হলোÑসোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বিডিবিএল এবং বেসিক ব্যাংক। বর্তমানে সোনালী ব্যাংকের সবচেয়ে বেশি অর্থ আটকে রয়েছে। আর খেলাপি ঋণ আদায়ে সবচেয়ে বেশি মামলা করেছে অগ্রণী ব্যাংক।
খাতসংশ্লিষ্টরা জানান, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো ঋণ দেয়ার সময় যাচাই-বাছাই করে দেয় না। তাই একটা সময় ঋণগুলো খেলাপিতে পরিণত হয়। এসব খেলাপি ঋণ আদায়ে ব্যাংক মামলা করে থাকে। যদিও এসব মামলা করে লাভ হয় না। কারণ বেশিরভাগ ঋণের ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত জামানত রাখা হয় না। তাই মামলা নিষ্পত্তি হলেও অর্থ আদায় করতে পারে না। অনেক সময় ঋণ দেয়া-নেয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব খাটানো হয়। এ কারণে ব্যবস্থাপনায় যারা থাকেন, তারাও কিছু বলতে পারেন না। ফলে সরকারি ব্যাংকগুলোয় দিন দিন খেলাপি ঋণ বাড়ছে। খেলাপি ঋণ আদায়ে মামলার সংখ্যা বাড়ছে। মামলার বিপরীতে জড়িত অর্থের পরিমাণও বাড়ছে।
তথ্যমতে, সোনালী ব্যাংকের ২০২৩ সাল শেষে ২৮ হাজার ৯৭৯ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ আদায়ে বিভিন্ন আদালতে ১৩ হাজার ৪০৫টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে অর্থঋণ আদালতে তিন হাজার ৩৯১টি মামলার বিপরীতে জড়িত অর্থের পরিমাণ ২৭ হাজার ৭১১ কোটি টাকা। এছাড়া রিট আদালতে ১৬৪ মামলায় ২৮ কোটি, সার্টিফিকেট আদালতে আট হাজার ৪৩৩টি মামলায় ৫৪ কোটি এবং অন্যান্য আদালতে এক হাজার ৪০৭টি মামলায় এক হাজার ১৮৬ কোটি টাকা আটকে রয়েছে।
দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা জনতা ব্যাংকের ২১ হাজার ৬০৬ কোটি টাকার খেলাপি ঋণের বিপরীতে বিভিন্ন আদালতে ১১ হাজার ৮৩৪টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে অর্থঋণ আদালতে দুই হাজার ৮২৭টি মামলার বিপরীতে আটক আছে ১৯ হাজার ৪১৮ কোটি টাকা। রিট আদালতে ১২৬টি মামলায় দুই হাজার ১৫৬ কোটি এবং সার্টিফিকেট আদালতে আট হাজার ৮৮১টি মামলায় ৩১ কোটি টাকা আটকে রয়েছে।
বেসিক ব্যাংকের বিভিন্ন আদালতে ১৩ হাজার ৬২৫ কোটি টাকা আদায়ে ৫২১টি মামলা করা হয়। সব টাকাই অর্থঋণ আদালতে আটকে রয়েছে।
খেলাপি ঋণ আদায়ে মামলা করার দিক থেকে শীর্ষে রয়েছে অগ্রণী ব্যাংক। ব্যাংকটি ১২ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ আদায়ে ১৭ হাজার ৭০৬টি মামলা করেছে। এর মধ্যে অর্থঋণ আদালতে ১১ হাজার ১৬৪ কোটি টাকা আদায়ে চার হাজার ৫৪৯টি মামলা করেছে। রিট আদালতে ১০৭টি মামলা করা হয় এক হাজার ৬১৮ কোটি টাকার বিপরীতে। সার্টিফিকেট আদালতে এক কোটি টাকা আদায়ে মামলা হয়েছে ১২ হাজার ৯৮৭টি।
এছাড়া রূপালী ব্যাংক সাত হাজার ৫১৫ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ আদায় করতে বিভিন্ন আদালতে পাঁচ হাজার ১০৮টি মামলা করেছে। অর্থঋণ আদালতে দুই হাজার ৫৭৫টি মামলা করা হয়। বিপরীতে জড়িত অর্থের পরিমাণ সাত হাজার ৩২৮ কোটি টাকা। এছাড়া রিট আদালতে ৮৯টি মামলায় জড়িত অর্থ ১৮১ কোটি এবং সার্টিফিকেট আদালতে দুই হাজার ৪৪৪টি মামলার বিপরীতে মাত্র পাঁচ কোটি টাকা।
অন্যদিকে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (বিডিবিএল) দুই হাজার ৭৯০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ আদায় করতে বিভিন্ন আদালতে ৫৪২টি মামলা করেছে। এর মধ্যে অর্থঋণ আদালতে ৪১৮টি মামলা করা হয়, যার বিপরীতে জড়িত অর্থ দুই হাজার ৭৮০ কোটি টাকা। এছাড়া সার্টিফিকেট আদালতে ৩০টি মামলা করা হয়। ১০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ আদায়ে এই মামলা করা হয়েছে।
বর্তমানে আদালতের বাইরে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (এডিআর) পদ্ধতিতে খেলাপি ঋণ আদায়ে ব্যাংকগুলোকে উৎসাহিত করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ৩১ জানুয়ারি ব্যাংকার্স সভায় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের এ বিষয়ে পরামর্শ দেন।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজাবউল হক বলেন, আদালতের মাধ্যমে মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতার কারণে বিভিন্ন সময়ে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমে ঋণ আদায়ে জোর দিতে বলা হয়। অনেক ক্ষেত্রে যোগ্য মধ্যস্থতাকারী না পাওয়া এবং মতভেদ দূর না হওয়ায় উদ্যোগ ফলপ্রসূ হয় না। এ অবস্থায় ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল আরবিট্রেশন সেন্টারের (বিয়াক) মতো প্রতিষ্ঠানের সহায়তা নিতেও বলা হয়। এছাড়া মামলা পরিচালনায় যোগ্য আইনজ্ঞকে নিয়োগ করতে বলা হয়। তবে এডিআরের সুবিধা নিয়ে কোনো গ্রাহক যাতে সময়ক্ষেপণ না করতে পারে, সে বিষয়েও সতর্ক করা হয়। এ বিষয়ে অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার বলেন, ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। সরকারি হিসাবে তা দেড় লাখ কোটি টাকা। তবে বাস্তবে তা চার লাখ কোটি টাকার বেশি। কারণ এখানে রাইট অফ ও মামলায় জড়িয়ে থাকা অর্থ দেখানো হচ্ছে না। এক যুগ আগে খেলাপি ঋণ অনেক কম ছিল। এটা এখন নিয়মিত বাড়ছে।
তিনি বলেন, খেলাপি ঋণ বাড়ছে মূলত যাচাই-বাছাই করে ঋণ দেয়া হয় না। আর বেশিরভাগ ঋণ পরিচালক, বোর্ড মেম্বার এবং রাজনৈতিক প্রভাশালী ব্যক্তিরা নিয়ে থাকে। ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ না করতে পারে না তাদের শক্ত অবস্থান না থাকার কারণে। এজন্য তাদের যাচাই-বাছাই ছাড়া বাধ্য হয়েই ঋণ দিতে হয়। যেকোনো ঋণ দিতে গেলে সঠিক যাচাই-বাছাই দরকার।
তিনি আরও বলেন, বেশিরভাগ বড় ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা কিন্তু রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে ঘটেছে। এসব ঋণ আদায়ে ব্যাংকগুলো মামলা করলে গ্রাহক স্টে অর্ডার (স্থগিতাদেশ) নিয়ে রেহাই পেয়ে যাচ্ছেন। তারা ব্যাংকের টাকা না দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তাই খেলাপিদের বিরুদ্ধে আইন কঠোর হওয়া দরকার। এক্ষেত্রে গ্রাহকের সম্পত্তি যেন ব্যাংক দখলে নিতে পারে, সে ব্যবস্থা থাকতে হবে। এ সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে যাতে ব্যাংক কোর্টের অনুমতি ছাড়াই বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে অকশনে দিতে পারে। কারণ কোর্টে মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা হয়। এছাড়া পাসপোর্ট বাজেয়াপ্তর মতো পদক্ষেপ নিতে হবে। তাহলে এখান থেকে বেরিয়ে আসা যাবে।