জন্মভূমি ডেস্ক : জাতীয় গ্রিডে বর্তমানে স্থানীয়ভাবে গ্যাস সরবরাহ হচ্ছে মোট ২০টি গ্যাস ক্ষেত্র থেকে। এর মধ্যে আটটি গ্যাস ক্ষেত্রের উৎপাদন অন্যগুলোর তুলনায় অনেক কম। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সেগুলো থেকে গ্যাস পাওয়া গেছে প্রায় ২০ বিলিয়ন কিউবিক ফুটের (বিসিএফ) মতো, যা মোট উত্তোলনের আড়াই শতাংশেরও কম। অথচ ক্ষেত্রগুলোর আওতাধীন কূপগুলোয় এখনো ৯১২ বিসিএফের বেশি গ্যাসের মজুদ রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে কার্যকর উদ্যোগ না নেয়ার কারণে উৎপাদন বাড়ানো যায়নি বলে মনে করছেন জ্বালানিসংশ্লিষ্টরা।
এ আট গ্যাস ক্ষেত্রের সবগুলোই স্থানীয় গ্যাস উত্তোলন কোম্পানির আওতাধীন। এর মধ্যে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রডাকশন কোম্পানি লিমিটেডের (বাপেক্স) পাঁচটি, সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেডের (এসজিএফএল) দুটি ও বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেডের (বিজিএফসিএল) রয়েছে একটি গ্যাস ফিল্ড।
জ্বালানি বিভাগের উইং হাইড্রোকার্বন ইউনিটের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশের ২০টি ক্ষেত্র থেকে গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে প্রায় ৮০৪ বিসিএফ। এর মধ্যে বাপেক্স, এসজিএফএল ও বিজিএফসিএলের আট ক্ষেত্র থেকে উত্তোলন করা হয়েছে মাত্র ১৯ দশমিক ৬৩ বিসিএফ গ্যাস। এ বিষয়ে তিন সংস্থার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, তাদের আওতাধীন অনেক কূপ সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, অনেকগুলোয় কাজও চলছে।
তথ্য বিশ্লেষণ করে আরো দেখা গেছে, জাতীয় গ্রিডে গত অর্থবছর স্থানীয়ভাবে প্রতিদিন গ্যাস সরবরাহ হয়েছে ২ হাজার ২০২ মিলিয়ন ঘনফুট (এমএমসিএফ)। এর মধ্যে নামসর্বস্ব আটটি ক্ষেত্র থেকে গ্রিডে দৈনিক গ্যাস সরবরাহ হয়েছে গড়ে ৫৩ দশমিক ৭৪ এমএমসিএফ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস।
দেশে গত অর্থবছর মোট গ্যাস উত্তোলনের অর্ধেকের বেশি মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি শেভরনের। কোম্পানিটির আওতাধীন তিনটি ক্ষেত্রের মোট গ্যাস উত্তোলন ছিল ৪৮৬ বিসিএফ। এর মধ্যে বিবিয়ানা থেকেই এসেছে ৪১৬ বিসিএফ গ্যাস। অন্যদিকে স্থানীয় তিনটি কোম্পানির আট গ্যাস ক্ষেত্র মোট উত্তোলন করেছে ১৯ দশমিক ৬৩ বিসিএফ গ্যাস। এর মধ্যে বাপেক্সের ফেঞ্চুগঞ্জ গ্যাস ক্ষেত্রের উত্তোলন ৪ দশমিক ৭৮ বিসিএফ, বেগমগঞ্জ ক্ষেত্রের ২ দশমিক ৯৬, সুন্দলপুরের ২ দশমিক ৮৯, সালদা নদীর ১ দশমিক ৪৬, সেমুতাংয়ের শূন্য দশমিক ২৫ বিসিএফ। এসজিএফসিলের সিলেট গ্যাস ফিল্ডের উত্তোলন ১ দশমিক ৯৯ বিসিএফ, বিয়ানীবাজারের ৪ দশমিক ১০ এবং বিজিএফসিএলের আওতাধীন মেঘনা গ্যাস ক্ষেত্রের উত্তোলন ছিল ১ দশমিক ২০ বিসিএফ গ্যাস। এসব ফিল্ডে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গ্যাস মজুদ ছিল ৯১১ বিসিএফ। যেখানে ফেঞ্চুগঞ্জের মজুদ ১৫৪ বিসিএফ, সিলেট গ্যাস ফিল্ডের ১৮৫, সালদা নদীর ১৭৬ ও সেমুতাংয়ের ৩০৩ বিসিএফ। বাকি গ্যাস ক্ষেত্রগুলোর মজুদ ২০-২৫ বিসিএফের মধ্যে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যেসব ক্ষেত্রের গ্যাস উত্তোলন সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমেছে সেগুলোর আওতাধীন অনেক কূপের সংস্কার করছে স্থানীয় গ্যাস উত্তোলনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। বাপেক্সের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, স্থানীয় পর্যায়ে গ্যাসের উত্তোলন বাড়াতে সুন্দলপুর-৩ ও ৪ উন্নয়ন কূপ, সুন্দলপুর সাউথ-১ অনুসন্ধান কূপ খননের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এছাড়া বেগমগঞ্জ গ্যাস ফিল্ডে চার নম্বরে উন্নয়ন কূপ খনন, ফেঞ্চুগঞ্জ সাউথ-১ অনুসন্ধান কূপ খননের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এসব কূপ থেকে চলতি বছরের মধ্যে জাতীয় গ্রিডে দৈনিক মোট ৫০ এমএমসিএফ গ্যাস যুক্ত হওয়ার কথা। এছাড়া অন্যান্য ফিল্ড মিলে মোট ২১১ এমএমসিএফ গ্যাস যুক্ত করার কথা জানিয়েছে বাপেক্স।
স্থানীয় কোম্পানিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম গ্যাস সরবরাহ করছে এসজিএফএল। সংস্থাটি জাতীয় গ্রিডে বর্তমানে প্রতিদিন ১০৩ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস দিচ্ছে। সবচেয়ে বেশি মজুদ নিয়ে কম সরবরাহের কারণ হিসেবে এসজিএফসিএলের কূপ খনন ও সংস্কার নিয়ে অবহেলাকেই দায়ী করছেন জ্বালানিসংশ্লিষ্টরা। তবে সংস্থাটির প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, চলতি বছরে বিয়ানীবাজার গ্যাস ফিল্ডের ৩ ও ৪ নম্বর এবং সিলেট সাউথ-১ অনুসন্ধান কূপ খননের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এছাড়া সিলেট-৮ ও বিয়ানীবাজার-১ কূপের ওয়ার্কওভারের কাজ শেষ করেছে। বর্তমানে বিয়ানীবাজার-২ ফিল্ডে থ্রিডি সিসমিক সার্ভে, সিলেট-১০-এ অনুসন্ধান কূপসহ বেশ কয়েকটি কূপ খনন প্রকল্পের উদ্যোগ নিয়েছে সংস্থাটি।
এসজিএফএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমাদের কোম্পানির আওতায় যেসব গ্যাস ফিল্ডের উত্তোলন নিম্ন পর্যায়ে নেমেছে, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সেগুলোয় উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বর্তমানে বিয়ানীবাজারে দুটি কূপ পুরোদমে উৎপাদনে রয়েছে, সেখানে আরো তিন-চারটি কূপ খননের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এছাড়া কৈলাসটিলা-৮ কূপের ওয়ার্কওভারের কাজ চলছে। আমাদের প্রত্যাশা হলো চলতি অর্থবছরে অন্তত তিনটি কূপের কাজ শেষ করে জাতীয় গ্রিডে গ্যাস সরবরাহ বাড়ানো।’
মেঘনা গ্যাস ফিল্ডের উৎপাদন বাড়ানোর বিষয়ে অবশ্য সুনির্দিষ্ট করে কোনো উদ্যোগের বিষয়ে জানাতে পারেননি এর নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিজিএফসিএলের কর্মকর্তারা। তাদের প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তিতাস, হবিগঞ্জ, মেঘনা, বাখরাবাদ ও কামতা গ্যাস ক্ষেত্রে মোট ১৬টি কূপ খনন ও সংস্কারের পরিকল্পনা রয়েছে।
দেশের উত্তোলনকৃত ক্ষেত্রগুলোয় ক্রমবর্ধমান হারে কমে আসছে গ্যাসের মজুদ, যা আগামী এক দশক নাগাদ ফুরিয়ে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এদিকে বড় আকারে স্থানীয় গ্যাসের সরবরাহ না বাড়ায় আমদানি করা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) ওপর নির্ভরতা বাড়াচ্ছে সরকার। তবে অবদান ও ব্যয় বিবেচনায় গ্যাস খাতে আমদানীকৃত এলএনজির ওপর এ নির্ভরশীলতা দেশের সার্বিক অর্থনীতিতেই নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাই সে পথে না হেঁটে বরং স্থলের পাশাপাশি সমুদ্রেও বড় আকারে অনুসন্ধানকাজ শুরুর কথা বলছেন তারা। পাশাপাশি স্থানীয় কূপগুলো সংস্কার করে সেখান থেকেও সরবরাহ বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। সরকার অবশ্য ২০২৫ সাল নাগাদ ৪৬টি কূপ খনন করে জাতীয় গ্রিডে ৬১৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের জোগান বাড়ানোর কথা জানিয়েছে। এর মধ্যে নয়টি কূপ খননকাজ শেষও হয়েছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক বদরূল ইমাম বলেন, ‘স্থানীয় গ্যাস উত্তোলন কোম্পানিগুলোর আওতায় গ্যাস ক্ষেত্রগুলোর আন্ডার পারফর্মিং। এসব ক্ষেত্রের কূপগুলোর দক্ষতা বাড়াতে কারিগরি উদ্যোগ অনেক আগেই নেয়া উচিত ছিল। দেশের গ্যাসকূপগুলোর উৎপাদন বাড়ানোর জন্য ২০১১ সালে স্লামবার্জারকে দিয়ে একটি সমীক্ষা করেছিল পেট্রোবাংলা। ওই সমীক্ষায় ৪৯টি কূপ শনাক্ত করেছিল বহুজাতিক কোম্পানিটি। সেগুলোয় উৎপাদন বৃদ্ধির বিষয়ে একটি সুপারিশ দিয়েছিল স্লামবার্জার, কিন্তু পেট্রোবাংলা সে বিষয়ে কারিগরি কোনো উদ্যোগ নেয়নি।’
এ বিশেষজ্ঞ মনে করেন, যেসব কূপ নামমাত্র উৎপাদনে রয়েছে, সেগুলোর দক্ষতা বৃদ্ধিতে কারিগরি উদ্যোগ নেয়ার এখনো সময় রয়েছে। যদি সেটা করা যায় তাহলে কূপের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। বিদেশী কোম্পানিগুলো তাদের আওতাধীন ফিল্ডে গ্যাসের উৎপাদন বৃদ্ধি ও সরবরাহ ধরে রাখতে পারলে স্থানীয় কোম্পানির গ্যাস ক্ষেত্রগুলোয় কেন সম্ভব নয়?
পেট্রোবাংলার ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বলেন, ‘গ্যাসের উত্তোলন বৃদ্ধির জন্য বৃহৎ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর অংশ হিসেবে এরই মধ্যে একটি গ্যাস ক্ষেত্র ও কয়েকটি নতুন কূপ খনন করা হয়েছে, যেখানে গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর মতো মজুদ রয়েছে। এসব ফিল্ডের আওতায় অবকাঠামোগত কাজও চলমান। এগুলো শেষ হলে চলতি বছর অন্তত ৬০-৮০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে।’