
বিশেষ প্রতিবেদক
সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে খুলনা নগরীতে বাড়ছে শব্দদূষণ। যা এখনই ছাড়িয়েছে সহনীয় মাত্রা। দূষণরোধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই বললেই চলে। আর পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পরে খুলনায় এই দূষণের মাত্রা বাড়বে বহুগুণ। এতে শব্দদূষণ জনিত স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়বে নগরবাসী।
মানুষের বা প্রাণীর শ্রæতিসীমা অতিক্রমকারী কোনো শব্দ সৃষ্টির কারণে শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনাই শব্দদূষণ। মানুষ সাধারণত ২০ থেকে ২০হাজার হার্জের কম বা বেশি শব্দ শুনতে পায় না। তাই মানুষের জন্য শব্দদূষণ প্রকৃতপক্ষে এই সীমার মধ্যেই তীব্রতর শব্দ দ্বারাই হয়ে থাকে। হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার, অনিয়ন্ত্রিত যান চলাচল ও উচ্চ স্বরে মাইকিং-এই দূষণের প্রধান কারণ বলছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডবিøইএইচও) মতে, মিশ্র এলাকায় শব্দের স্বাভাবিক মাত্রা ৬০ ডেসিবলের বেশি হলে মানুষের সাময়িক বধিরতা এবং শব্দের মাত্রা ১০০ ডেসিবল হলে তা স্থায়ী বধিরতা সৃষ্টি করতে পারে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলছেন, অতিরিক্ত শব্দ মানুষের স্নায়ুতন্ত্রের স্বাভাবিক কাজকর্মে বিঘœ ঘটায়। ফলে মানুষের হৃৎপিন্ডের স্বাভাবিক রক্ত চলাচলের ক্ষতি করে। শিশু, অন্তঃসত্ত¡া ও হৃদরোগীদের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ শব্দদূষণ। এর ফলে মানুষের শ্রবণ শক্তি লোপসহ মানুষ আংশিক বা পুরোপুরি বধির হয়ে যেতে পারে। এর ফলে পরিপাক যন্ত্রের কাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। ফলে আলসার ও অন্যান্য অনেক পীড়ায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়।
খুলনা পরিবেশ অধিদপ্তরের থেকে পাওয়া সর্বশেষ ২০২১ সালের মে থেকে আগস্ট পর্যন্ত শব্দের মাত্রার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, শহরের গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলোতে শব্দের সহনীয় মাত্রা ৬০ ডেসিবল পেরিয়ে গেছে। গল্লামারী মোড়ে ৮২ ডেসিবল, ফুলবাড়ী গেট মোড়ে ৭৮, কৈয়া বাজার মোড়ে ৭৮, ডিসি অফিস মোড়ে ৭৭, ডাকবাংলা মোড়ে ৭৫, শিরোমণি বাজারে ৭৬, নতুন রাস্তা মোড়ে ৭৪, বিএল কলেজ মোড়ে ৭৩, শিববাড়ি মোড় ও নিউমার্কেট মোড়ে ৭২, শান্তিধাম মোড়ে ৭০, পিটিআই মোড়ে ৬৯ এবং চিত্রালী মোড়ে ৬৪ ডেসিবল পর্যন্ত শব্দের মাত্রা। শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৬ অনুসারে নীরব এলাকায় দিনে ৪৫ ডেসিবল এবং রাতে ৩৫ ডেসিবলের মধ্যে শব্দের মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আবাসিক এলাকায় এই মাত্রা দিনে ৫০ ও রাতে ৪০ ডেসিবল। এ ছাড়া বাণিজ্যিক এলাকায় দিনে ৭০ ও রাতে ৬০ ডেসিবল, শিল্প এলাকায় দিনে ৭৫ ডেসিবল ও রাতে ৭০ ডেসিবল এবং মিশ্র এলাকায় দিনে ৬০ ও রাতে ৫০ ডেসিবল শব্দের মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
ট্রাফিক আইনের ৪৫ এর উপ-ধারা ২,৩ ও ৪ অনুসারে এর বিধান কেউ লঙ্ঘণ করলে ৩ মাসের কারাদÐ বা ১০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দÐে দÐিত করার বিধান যুক্ত হয়েছে। আর চালকের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত দোষ সূচক ১ পয়েন্ট কাটা হবে।
বিআরটিএ খুলনা সার্কেলের সাবেক বিভাগীয় পরিচালক জিয়াউর রহমান বলেন, সচেতনতাই সবথেকে বড় প্রতিকার। আমরা সচেতনতা বাড়াতে নিয়মিত প্রচার চালাচ্ছি। এমনকি জরিমানাও করছি। শব্দদূষণ বন্ধে পরিবেশ অধিদপ্তর, বিআরটিএ, পুলিশ প্রশাসন ও জেলা প্রশাসন সমন্বিতভাবে কাজ করলে সুফল মিলবে।
হৃদ্রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. বিধান চন্দ্র গোস্বামী বলেন, উচ্চমাত্রার শব্দ মানবদেহে রক্তচাপ ও হৃৎকম্পন বাড়িয়ে মৃত্যুঝুঁকি তৈরি করতে পারে। বিশেষ করে শিশুদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়।
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সাবেক ইএনটি প্রধান ডা. সোলইমান বলেন, ক্রমাগত শব্দদূষণে কানের টিস্যুগুলো আস্তে আস্তে বিকল হয়ে পড়ে। ফলে শ্রবণশক্তি কমে বধির হওয়ার মতো অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। এছাড়া মাত্রাতিরিক্ত শব্দ স্নায়ু দুর্বল করে কর্মদক্ষতা কমিয়ে দিতে পারে।
খুলনা মেট্রোপলিটন ট্রাফিক পুলিশের উপ কমিশনার মো: তাজুল ইসলাম বলেন, কিছু বখাটে বা আইন অমান্যকারী গলিপথের মধ্যে যানবাহনে উচ্চ শব্দ তৈরি করে পরিবেশ দূষণ করেন। মোটরযানে উচ্চ শব্দ রোধে কাজ করছে ট্রাফিক বিভাগ। তারা নিয়মিত চেক পোষ্ট পরিচালনার মাধ্যমে আইন অমান্যকারীদের জরিমানা করছেন। তিনি সকলকে ট্রাফিক আইন মেনে চলার পাশাপাশি আরও সচেতন হওয়ার আহবান জানান।
পরিবেশ অধিদপ্তরের খুলনা বিভাগীয় পরিচালক মোঃ ইকবাল হোসেন বলেন, খুলনায় শব্দের মাত্রা মানমাত্রা ছাড়িয়ে দূষণ পর্যায়ে চলে গেছে। আইন প্রয়োগে কিছুটা সীমাবদ্ধতা আছে। শব্দদূষণের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করা ও হাইড্রোলিক হর্ন ও যানবাহনে মাত্রাতিরিক্ত শব্দ বন্ধে এখনই সমন্বিতভাবে কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে শব্দদূষণ আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।